ঘিঞ্জি, অপরিকল্পিত পুরুলিয়া শহর। নতুন নীতির ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা। ছবি: সুজিত মাহাতো।
বাড়ির গায়ে গা লাগিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বহুতল। আর বহুতলের জাঁতাকলে বাড়ির লোকেদের দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেখানে না ঢোকে আলো, না খেলে বাতাস।
বাড়ি নির্মাণ নিয়ে রাজ্য সরকারের নয়া নীতিতে শুধু কলকাতা শহরই নয়, তার গণ্ডী ছাড়িয়ে জেলার সদর-শহর বা অন্য ছোট-বড় শহরেও অদূর ভবিষ্যতে এই ছবি দেখা যাবে বলে আশঙ্কা সেখানকার বাসিন্দাদের। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া শহরের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশও এই আশঙ্কারই শরিক। ‘ছাদের গায়েতে ছাদ মরে মাথা কুটে...’শৈশবের সহজপাঠের সেই লাইনটার কথাও মনে পড়ছে কারও কারও।
মঙ্গলবার রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই নতুন নগরোন্নয়ন নীতি অনুমোদিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি পুরনো বাড়ির ভাড়াটেরা মালিকের প্রস্তাবে সম্মত হলে সেই সব বাড়ি ভেঙে তৈরি করা যাবে নতুন বাড়ি। সে ক্ষেত্রে বাড়ির ফ্লোর এরিয়ার অতিরিক্ত ১০০% নির্মাণের ছাড়পত্র মিলবে। কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের যে কোনও শহরে বিপজ্জনক বাড়ি নতুন করে নির্মাণ করা হলেও মিলবে ১০০% অতিরিক্ত ফ্লোর এরিয়ার ছাড়পত্র।
আর নগরোন্নয়নের এই নয়া নীতিতেই আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়েছে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া, দুই শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে। কারণ, দুই শহরেই পুরনো বাড়ির সংখ্যা কম নয়। আবার ভাড়াটেশুদ্ধ ৫০ বছরের পুরনো বাড়িও অসংখ্য। এই অবস্থায় নতুন নীতি রূপায়িত হলে দুই শহরেই প্রোমোটারি কারবার ফুলেফেঁপে উঠবে বলে মনে করছেন সেখানকার বাসিন্দাদের বড় অংশই। আর সেই কারবারের হাত ধরে সিন্ডিকেট ও তোলাবাজির রমরমা শুরু হবে কি না, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে তাঁদের।
বস্তুত, ভাড়াটে উচ্ছেদ নিয়ে জেরবার মালিকেরা যদি ভাড়াটেকে মানিয়ে প্রোমোটারের হাতে বাড়ি তুলে দিতে শুরু করেন, তা হলে আগামী দিনে দুই শহরেই ব্যাঙের ছাতার মতো বহুতল গজিয়ে উঠতে পারে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে দিনে দিনে দু’টি শহরই আড়েবহরে বাড়ছে। বছর পাঁচ-সাত আগেও শহরের যে চৌহদ্দি ছিল তা ছাড়িয়ে গিয়ে পরের পর বাড়ি তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, সেই তুলনায় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ছে না। পুরুলিয়া শহরের পুরনো এলাকা বলে পরিচিত চকবাজার, ন’ডিহা, আমলাপাড়া, নামোপাড়া, নাপিতপাড়া এই সমস্ত এলাকার বেশির ভাগ জায়গাতেই গায়ে গা লাগানো বাড়ি। সমস্যাও রয়েছে একাধিক। দুই বাড়ির মাঝে জল ঢুকে দেওয়াল স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গিয়েছে। জানলা খুলে রাখতে গেলেও নানা অসুবিধা। নামোপাড়ার বকুলতলা লেনের বাসিন্দা সরমা সেনের কথায়, “গায়ে গা লাগানো বাড়িতে নানা অসুবিধে। আলো-বাতাস ঢোকে না। তার উপর বাড়ির গা ঘেঁষে বহুতল হলে তো সমস্যা আরও বাড়বে।” লালমোহন ত্রিবেদী লেনের বাসিন্দা নমিতা দাশগুপ্ত বলেন, “ঘিঞ্জি এলাকা বলে জানলা খুলে রাখতে পারি না। দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়।”
তারাপীঠে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বহুতল।
ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।
বাঁকুড়া শহরেরও লালবাজার, নতুনগঞ্জ, কেঠারডাঙ্গা, শাঁখারিপাড়া, পাঠকপাড়ার মতো যে সমস্ত এলাকা পুরাতন বাঁকুড়া বলে পরিচিত, সেখানেও ছবিটা একই। নতুনগঞ্জের এক প্রবীণ বাসিন্দার কথায়, “আমাদের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় হঠাৎ করে যদি পুরনো কোনও একতলা বাড়িকে ভেঙে প্রোমোটার চার বা পাঁচ তলা বাড়ি তৈরি করেন এবং সেই বাড়ির আশপাশে যথেষ্ট খোলা জায়গা না রাখা হয়, তা হলে সমস্যা তো হবেই। একেই গা ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ির জন্য হাওয়া খেলে না। তার উপর একাধিক বহুতল তৈরি হলে লোকের সংখ্যা যেমন এক ধাক্কায় বাড়বে, তেমনই এলাকার পরিবেশের ভারসাম্যও বিঘ্নিত হবে।”
পুরুলিয়া পুরসভা সূত্রে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালের পুর-নির্মাণ বিধি মোতাবেক, বাড়ির দু’দিকে ন্যূনতম চার ফুট করে জমি ছেড়ে রাখতে হবে। এই বিধি তিনতলা অবধি বাড়ির জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু, তার বেশি হলে এক দিকে প্রায় পাঁচ ফুট, অন্য দিকে আট ফুট জমি ছেড়ে রাখার নিয়ম। পুরসভার সহকারী বাস্তুকার রাজীব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দু’টি বাড়ির মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছেড়ে রাখা দরকার নানা কারণে। তাতে দু’পক্ষেরই সুবিধা। বাড়ির সংস্কার কাজ, নিরাপত্তার বিষয়, এ সব মাথায় রাখা দরকার।
কিন্তু, রাজ্য সরকারের নয়া সিদ্ধান্তে সে সব কি বজায় থাকবে? এ প্রশ্নের উত্তর পুরসভার তরফে মেলেনি। তবে, পুরসভার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী বাস্তুকার অসীম সরকার বলেন, “দু’টো বাড়ির নির্মাণ যদি গায়ে গা লাগানো অবস্থায় হয়, তাহলে নানা অসুবিধা। ধরুন আমি বাড়ি সংস্কার করব। ফাঁকা জমি না থাকলে সেই কাজ কী ভাবে করব? তা ছাড়া আলো-বাতাস ঢোকাটাও তো বাড়ি ও সেখানে থাকা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি।” যদি গায়ে গা লাগানো বহুতল গড়ে ওঠে? অসীমবাবুর জবাব, “সেটা অসুবিধারই হবে।” একই মত পোষণ করেছেন পুরুলিয়া নাগরিক মঞ্চের সম্পাদক গোবিন্দ কুণ্ডু।
রাজ্য সরকারের নতুন নগরোন্নয়ন নীতিকে সমর্থন করছেন না পুরুলিয়া পুরসভার বিরোধী দলনেতা বিভাস দাস। তাঁর বক্তব্য, “এই শহরের বেশির ভাগ এলাকায় এমনিতেই গায়ে গায়ে বাড়ি। তার উপর বাড়ি ঘেঁষে বড় বহুতল উঠলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।” একই প্রশ্ন তুলেছেন বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও। তাঁদের কথায়, “যে ভাবে শহরের উপর চাপ বাড়ছে, সেই অনুসারে তো নাগরিক পরিষেবা বাড়ছে না। এখনও সর্বত্র নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছয়নি। এর সঙ্গে প্রোমোটার রাজ শুরু হলে ভূগর্ভস্থ জলের উপরে চাপ অসম্ভব বাড়বে। কারণ, বহুতলগুলি জলের জন্য গভীর নলকূপের উপরেই ভরসা করে। ফলে, পরের পর বহুতল গজালে, ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ারেও টান পড়বে।
নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা অবশ্য এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। বাঁকুড়ায় আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগকারীদের অন্যতম সৌমিত্র ভট্টাচার্য ও সমীরণ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “সরকারের নতুন নীতি আবাসন শিল্পের পক্ষে ভাল দিক। জমি সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জটিলতা থাকলে সেই সমস্যা মিটিয়ে কাজ শুরু করতে অনেকটা সময় লেগে যেত। নতুন নীতিতে সেই সমস্যা অনেকটা কমবে।” বাঁকুড়া চেম্বার অউ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপা বলেন, “পুরসভায় বাড়ি বানানোর জন্য যে সমস্ত জটিলতা ছিল, তা কেটে গেলে ভাল। পাশাপাশি শহরের পরিকাঠামো উন্নয়নের বিষয়টিও ভাবা দরকার। কেন না, শুধু বসতি বাড়লেই তো হল না। সেই অনুযায়ী নাগরিক পরিষেবাও পৌঁছে দিতে হবে পুরসভাকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy