পঞ্চায়েতে অনাস্থা এনে দলীয় প্রধান যাতে বিপাকে না পড়েন, তা নিশ্চিত করতে রাজ্য এবং জেলা নেতারা বিভিন্ন সময় নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু, দলীয় নেতৃত্বের সেই নির্দেশকে থোড়াই কেয়ার করে পুরুলিয়ার পঞ্চায়েতগুলিতে অনাস্থা আনার রীতি অব্যাহত।
মানবাজার ২ ব্লকের আঁকরো-বড়কদম গ্রাম পঞ্চায়েতে দলেরই এক গোষ্ঠীর আনা অনাস্থায় মঙ্গলবার পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন ওই পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান। বিডিও (মানবাজার ২) পার্থ কর্মকার জানিয়েছেন, এ দিন ওই পঞ্চায়েতের তৃণমূলের প্রধান রেখা মণ্ডলের বিরুদ্ধে অনাস্থার ভোটাভুটি ছিল। অনাস্থার পক্ষে ১১ জন পঞ্চায়েত সদস্য উপস্থিত ছিলেন। প্রধান-সহ ৩ জন সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। আস্থাভোটে হেরে রেখাদেবী প্রধান পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন। বিডিও বলেন, “নতুন প্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু হবে।” অন্য দিকে, এ দিনই পুরুলিয়ার জয়পুর ব্লকের বড়গ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের বামফ্রন্ট প্রধান ভারতী মাহাতো অপসারিত হয়েছেন আস্থা ভোটে। আর পঞ্চায়েতের দখল নেওয়ার পথে তৃণমূল। এ ক্ষেত্রে তৃণমূলের সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন সিপিএমেরই এক পঞ্চায়েত সদস্য!
পুরুলিয়ার বিভিন্ন পঞ্চায়েতে গত এক-দু’মাস ধরেই অনাস্থা আনার যেন ঢল নেমেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনাস্থার নেপথ্যে রয়েছে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এই প্রবণতা বিশেষ করে চোখে পড়েছে রঘুনাথপুর অঞ্চলে। এখানে পঞ্চায়েত তো বটেই, এমনকী পঞ্চায়েত সমিতিতেও তৃণমূল সদস্যদের একাংশ অনাস্থা এনে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন দলেরই সহ-সভাপতি বা কর্মাধ্যক্ষকে। মানবাজার ২ ব্লকের আঁকরো-বড়কদম গ্রাম পঞ্চায়েতেও সেই দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরই ছায়া দেখেছেন তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। বস্তুত, রেখা মণ্ডলকে প্রধান পদ থেকে অপসারিত করে দলের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী একটি অন্য বার্তাও দিয়েছেন। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মানবাজার ২ ব্লকের সভাপতি পদে থাকা প্রভাস মণ্ডলের পূত্রবধূ হলেন রেখাদেবী। তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থায় অবিচল থেকে তাঁকে শেষ পর্যন্ত পদচ্যুত করা এক অর্থে ব্লকের ক্ষমতাসীন নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করা, এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে প্রভাসবাবু বলেন, “দলীয় নির্দেশ অমান্য করেই এই অনাস্থা। বিষয়টি জেলা নেতৃত্বকে জানিয়েছি।”
দলের প্রধানদের বিরুদ্ধে অনাস্থা না আনার নির্দেশ যে দলেরই একাংশ মানছেন না, তা স্বীকার করে তৃণমূলের জেলা নেতা নবেন্দু মাহালি জানান, অনাস্থা প্রস্তাবের উপরে ভোটাভুটির দিন দলের কোনও সদস্য যাতে পঞ্চায়েত অফিসে হাজির না থাকেন, এ রকম পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ব্লক স্তরের নেতারাও অনাস্থা রোখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। “এখন বোঝা যাচ্ছে, ওই নির্দেশ বা পরামর্শ দলের একাংশ মানেননি।”আক্ষেপ জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোর ঘনিষ্ঠ নেতা হিসাবে পরিচিত নবেন্দুবাবুর।
আঁকরো-বড়কদম পঞ্চায়েতে মোট আসন ১৪। হত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল ১৩টি এবং সিপিএম ১টি আসন পেয়েছিল। এক সপ্তাহ আগে রেখাদেবীর বিরুদ্ধে ১১ জন তৃণমূল সদস্য অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তাঁদের অন্যতম, ওই পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান অনিল মাহাতোর অভিযোগ, পঞ্চায়েত গঠন হওয়ার পর থেকেই রেখাদেবী সংসদ এলাকার উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈঠকে অন্য সদস্যদের মতামতকে আমল দিতেন না। স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েছেন। এমনকী কয়েক মাস পঞ্চায়েত অফিসে না এলেও কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেননি। অনিলবাবু বলেন, “আমরা এলাকার মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। দলের নেতাদের একাংশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চান। তাই আমরা সমস্ত পঞ্চায়েত সদস্য একজোট হয়েছি।” রেখাদেবীর পাল্টা বক্তব্য, “ওই সদস্যেরা বিভিন্ন সময় আমার কাছে আর্থিক সুবিধা নিতে চাইতেন। আমি দিতে অস্বীকার করায় আমার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন।”
জয়পুরের বড়গ্রাম পঞ্চায়েতে অবশ্য তৃণমূল নয়, বরং বামফ্রন্টেই দ্বন্দ্ব! সেখানে তৃণমূলের সঙ্গে এক সিপিএম ও নির্দল সদস্যের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি ছিল মঙ্গলবার। অনাস্থার পক্ষে সাতটি ভোট পড়েছে। এই পঞ্চায়েতে ১২টি আসন। সিপিএমের ৪, ফরওয়ার্ড ব্লকের ২ ও নির্দলের এক সদস্যএই ৭ জনকে নিয়ে বোর্ড চালাচ্ছিল বামফ্রন্ট। ৫টি আসন ছিল তৃণমূলের। ১৩ নভেম্বর প্রধান ভারতী মাহাতোর বিরুদ্ধে আনাস্থার চিঠি দেন তৃণমূলের সদস্যেরা। তাতে সিপিএম এবং নির্দল এক সদস্যও সই করেন। এ দিন আস্থা ভোটে চিঠিতে সই থাকা ৭ জনই পঞ্চায়েতে উপস্থিত ছিলেন। প্রধান-সহ ফ্রন্টের বাকিরা আসেননি। যুগ্ম-বিডিও (জয়পুর) শিবাজী বসু বলেন, “অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে সাত জন মত দিয়েছেন। এক মাসের মধ্যে নতুন প্রধান দায়িত্ব নেবেন।”
পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য অঞ্জু চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, “প্রধান পঞ্চায়েত পরিচালনায় বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা করতেন না। সেই কারণেই অনাস্থা আনা হয়েছিল।” সিপিএমের জয়পুর জোনাল কমিটির সম্পাদক পশুপতি মাহাতো বলেন, “আমাদেরই এক সদস্য তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তৃণমূল প্রলোভন দেখিয়েই তাঁকে অনাস্থার চিঠিতে স্বাক্ষর করিয়েছে। বিভিন্ন জায়গাতেই এই অবস্থা চলছে।” অভিযোগ অস্বীকার করে জয়পুরের তৃণমূল নেতা কীর্তন মাহাতো বলেন, “প্রলোভন দেখালে তো ওদের বিধায়কেরাও আমাদের দিকে চলে আসতেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy