চালকলের বর্জ্যযুক্ত জল মিশছে জমিতে। ছবি: উদিত সিংহ
জানলা খোলার উপায় নেই। খালি চোখে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা দুষ্কর। কোপ পড়ছে জমির ফসলে। সমস্যার কারণ চালকলের দূষণ, অভিযোগ পূর্ব বর্ধমানের সদর এলাকা থেকে গলসি, রায়না, খণ্ডঘোষের মতো নানা এলাকার বাসিন্দাদের। মাঝেমধ্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অভিযান চালায়। কিন্তু দূষণে রাশ পড়ে না, দাবি তাঁদের।
চালকল মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, রাজ্যে ১,১৫০টি চালকল রয়েছে। দূষণের অভিযোগ রয়েছে সর্বত্রই। পূর্ব বর্ধমানে চালকলের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশো। বর্ধমান থেকে আরামবাগ বা বাঁকুড়া যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোলেই দেখা যায়, পথের দু’পাশে ছাই পড়ে কালো হয়ে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রাতে রাস্তার ধারে বা দামোদরের পাড়ে চালকলের ছাই ফেলা হয়।
রায়না, মাধবডিহি, খণ্ডঘোষ, বর্ধমান, গলসির চাষিদের অনেকের অভিযোগ, চালকলের বর্জ্য যুক্ত জল খেত দিয়ে বয়ে যায়। তাতে জমির ক্ষতি হচ্ছে। ফলন কমে যাচ্ছে। চালকলের ছাইয়ে ফসল যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষের যন্ত্রণাও বাড়ছে। রায়নার সুজাতা সামন্তের কথায়, ‘‘ঘুম থেকে উঠে আমাদের প্রথম কাজ, ছাদ থেকে চালকলের নোংরা সাফ করা। দিনভর চালকলের ছাইয়ের জন্য জানলা পর্যন্ত খুলতে পারি না!’’
খণ্ডঘোষের বাসিন্দা সাইদুল আলমের অভিযোগ, ‘‘খালি চোখে বাইরে বেরোলে ছাই উড়ে এসে পড়ে। রাস্তার দু’ধারে চালকলের ছাই পড়ে থাকে। যাতায়াত করা যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’ বর্ধমানের আলমগঞ্জ এলাকায় পুরনো চালকলগুলির আশপাশে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। সেখানকার বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, দূষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
‘বর্ধমান রাইসমিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর কর্তারা জানান, দূষণ নিয়ে তাঁরাও চিন্তিত। চালকল মালিক সমিতি সূত্রের দাবি, রাজ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচশো চালকলে জ্বালানি হিসেবে তুষ ব্যবহার হয়। পূর্ব বর্ধমানে সেই সংখ্যা ১৩২। ওই ধোঁয়া দূষণ ঘটায়। সমিতির রাজ্য কার্যকরী সভাপতি আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘এক দিকে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, অন্য দিকে, পরিবেশ দফতরের পরামর্শ মতো চালকল চালানোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, কয়েকবছর আগে আউশগ্রামের শিবদায় দূষণ নিয়ে এলাকাবাসী ও চালকলগুলির অশান্তি হওয়ায় তিনি শহরের বাইরে ‘ফুড পার্ক’ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু জমির অভাবে সে প্রস্তাব বছর তিনেক ধরে আটকে রয়েছে। ওই সংগঠনের সম্পাদক সুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘নতুন প্রযুক্তিতে বায়ু দূষণ হয় না। তবে চালকলের ছাইয়ে দূষণ হয়। ওই ছাই ব্যবহার করে বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম তৈরি করা যেতে পারে। ছ’বছর আগে বেঙ্গালুরুতে একটি পাইলট প্রজেক্ট আমরা দেখে এসেছিলাম। সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘‘চালকলের দূষণের বিষয়ে কড়া আইন রয়েছে। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’ রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চিফ ইঞ্জিনিয়ার (অপারেশন্স অ্যান্ড এগজ়িকিউশন) সুব্রত ঘোষের বক্তব্য, ‘‘চালকলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা রয়েছে।’’ চালকলের দূষণ কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে? খড়্গপুর আইআইটি-র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শীর্ষেন্দু দে ও গবেষক অনিমেষ জানার মতে, চালকলগুলি প্রতিদিন মাটির নীচ থেকে প্রচুর পরিমাণে জল তোলে। তা দিনে দু’তিন বারের বেশি পুনর্ব্যবহার করা যায় না। বর্জ্য যুক্ত জল বাইরে ফেলে দিতে হয়। তাতে চাষের জমির ক্ষতি হয়। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্জ্য পদার্থ বার করে জৈব সার তৈরি করেছি, যা বাগানে কাজে লাগে। বাকি জল পরিষ্কার করে ব্যবহারের উপযুক্ত করা হয়েছে। এর পাইলট প্রজেক্ট সফল হওয়ায় একটি সংস্থা প্রযুক্তিটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’
দুর্গাপুর এনআইটি-র অধ্যাপক তমাল মণ্ডলের দাবি, “ছাই থেকে ‘সিলিকা’ বার করা হয়। তা বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম তৈরি, রং, কাচশিল্পে কাজে লাগবে। বাকিটা দিয়ে ‘অ্যাক্টিভেটেড কার্বন’ তৈরি করা হচ্ছে, যা জল শোধনে প্রয়োজন হবে।’’ তাইল্যান্ডের ‘এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’র (এআইটি) শিক্ষিকা জয়শ্রী রায় জানান, পূর্ব বর্ধমানে প্রচুর চাল উৎপাদন হয়, যা থেকে ভাল পরিমাণ তুষ মেলে। তুষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চালকল চালানো যেতে পারে। তাতে দূষণও কমবে, ফসলেরও ক্ষতি হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy