মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
দীপাবলির পরের দিনই সংগঠনে বড়সড় রদবদল করল তৃণমূল। সোমবার দুপুরে বাংলার শাসক দল বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও চেয়ারপার্সন পদে রদবদল করেছে। কোথাও দুই পদেই বদল এনেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কোথাও আবার একটি পদে বদল আনা হয়েছে। আবার এমন অনেক সাংগঠনিক জেলা রয়েছে, যেখানে কোনও বদলই করেনি কালীঘাট এবং ক্যামাক স্ট্রিট। যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরই রেখে দেওয়া হয়েছে। রদবদলের গোটা তালিকা দেখে তৃণমূলের একাংশ নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন, লোকসভা ভোটের আগে সংগঠনকে ‘নির্মেদ ও টানটান’ করতে চেয়েছেন নেত্রী ও সেনাপতি। যেখানে যেখানে নেতৃত্বের মধ্যে বিবিধ কারণে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ গ্রাস করছিল, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এমন অনেক সাংগঠনিক জেলা রয়েছে, যেখানে সভাপতি বা চেয়ারপার্সনদের সঙ্গে জেলার বিধায়ক, সাংসদ, ব্লক সভাপতিদের বনিবনার অভাব রয়েছে, সেখানেও নেতা বদল করে দেওয়া হয়েছে।
মনে করা হচ্ছে, আকস্মিক ভাবে বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে এই সাংগঠনিক কাঠামো নিয়েই লোকসভা ভোটে ঝাঁপাবে তৃণমূল। সে দিক থেকে এই রদবদল রাজনৈতিক ভাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। তৃণমূলের একটি অংশের বক্তব্য, তালিকা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট— প্রথমত, পরিচিতি রয়েছে এমন নেতাদের সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যে কারণে একাধিক সাংগঠনিক জেলায় সভাপতি ও চেয়ারপার্সন পদে আনা হয়েছে বিধায়ক বা সাংসদকে। দ্বিতীয়ত, সভাপতি বা চেয়ারপার্সন পদে থাকা যে যে নেতানেত্রীর বিরুদ্ধে দলের একটি বড় অংশের ক্ষোভ ছিল। যা আসলে চুঁইয়ে নিচুতলায় পৌঁছে সংগঠনের বুনিয়াদি জায়গায় আঘাত হানছিল। সেই সব জায়গায় বদল করা হয়েছে।
অনুব্রত আর সভাপতি নন
এই রদবদলে ‘তাৎপর্য’ দেখা গিয়েছে বীরভূম জেলা সংগঠনে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অনুব্রত মণ্ডল ছিলেন জেলা সভাপতি। তাঁর সাংগঠনিক প্রতাপ বাংলার রাজনীতিতে সর্বজনবিদিত। গরু পাচার মামলায় অনুব্রত এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলবন্দি। তা-ও তাঁকেই জেলা সভাপতি রেখে দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু মঙ্গলবার প্রকাশিত তালিকা বলছে, অনুব্রতকে শুধু তৃণমূল জেলা সভাপতি পদ থেকে সরানো হল, তা-ই নয়। বীরভূম জেলাকেই ‘সভাপতিহীন’ করে দেওয়া হল। ‘চেয়ারপার্সন’ করা হয়েছে রামপুরহাটের বিধায়ক তথা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সভাপতির জায়গায় লেখা রয়েছে, কোর কমিটি সমন্বয় করবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কাউকে সভাপতি করা হয়নি। প্রসঙ্গত, বছর খানেক আগে নেতাজি ইনডোরের সভা থেকে মমতাই বলেছিলেন, যত দিন কেষ্ট না ফিরছেন, তত দিন তিনিই বীরভূমের সংগঠন দেখবেন। তার পর জেলায় গিয়ে বেশ কয়েক জনকে নিয়ে একটি কোর কমিটিও গ়ড়ে দিয়ে এসেছিলেন। সেখানে জায়গা পেয়েছিলেন জেলার রাজনীতিতে ‘অনুব্রত-বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত কাজল শেখের মতো নেতা। অনেকের মতে, এক জনকে সভাপতি করলে বীরভূমে নেতাদের মধ্যে রেষারেষি বাড়ত। সেটা বুঝেই হয়তো এই সাংগঠনিক পন্থা নিয়েছে তৃণমূল।
মহুয়াকে সাংগঠনিক পদ
সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে ঘিরে ‘বিতর্কের আবহে’ তাঁকে সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে তৃণমূল। কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সভানেত্রী করা হয়েছে সাংসদ মহুয়াকে। সংসদে ‘ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন’ নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, তখন মহুয়ার পাশে দাঁড়িয়ে সরাসরি কোনও বিবৃতি দেয়নি তৃণমূল। বরং মহুয়ার বিষয়টিকে তাঁর ‘নিজস্ব’ লড়াই হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল দলের তরফে। বিরোধীদের অনেকেই প্রশ্ন তুলছিলেন, মহুয়ার পাশে কেন দল দাঁড়াচ্ছে না? দেখা গেল, মুখে বলে পাশে দাঁড়ানোর বদলে মহুয়াকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দিল তৃণমূল। যা সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলেই মনে করছে তৃণমূলের অন্দরের একটি অংশ। অনেকের মতে, এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হল যে, দল মহুয়ার পাশে রয়েছে। আবার অন্য একাংশের মতে, মহুয়াকে যদি আগামী লোকসভা ভোটে দাঁড়াতে না-দেওয়া হয়, তখন তাঁকে সাংগঠনিক ভাবে কাজে লাগাবে দল। এই সিদ্ধান্ত সেই বার্তাও হতে পারে। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর তৃণমূল সাংগঠনিক খোলনলচে বদল করে। তখন থেকেই এক একটি প্রশাসনিক জেলাকে একাধিক সাংগঠনিক জেলায় ভাগ করেছিল শাসকদল। তার আগে নদিয়া জেলার সভাপতি ছিলেন মহুয়া। কিন্তু নদিয়াকে ভেঙে যখন কৃষ্ণনগর ও রানাঘাটের মধ্যে ভাগ করে তৃণমূল তখন আর মহুয়াকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। শুধু সাংসদ হিসাবেই ছিলেন তিনি। কল্লোল খাঁ ছিলেন কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি। তিনিও অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে নদিয়ার এই অংশে সংগঠনের শীর্ষপদে ‘নিষ্ক্রিয়তা’ দূর করাও তৃণমূলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
শাওনির অপসারণ
বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার সভানেত্রী পদ থেকে শাওনি সিংহ রায়কে সরিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে বিধায়ক অপূর্ব সরকার ওরফে ডেভিডকে। শাওনিকে রাজ্য সম্পাদক করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে-পরে এই শাওনির বিরুদ্ধেই ‘বিদ্রোহ’ ঘোষণা করেছিলেন ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, হুমায়ুনকে শো কজ় করেছিল তৃণমূল। শাওনিকে জেলা সভানেত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে সেই হুমায়ুন বলেছেন, ‘‘লঙ্কা রাবণমুক্ত হল। লোকসভায় ভাল ফল হবে।’’ অনেকের মতে, দলের নেতাদের সঙ্গে বনিবনার অভাবের কারণেই সরতে হল শাওনিকে।
সুকান্ত ও শুভেন্দুর জেলায় রদবদল
বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরে তৃণমূলের জেলা সংগঠনে রদবদল করা হয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের দু’টি সাংগঠনিক জেলাতেই রদবদল করেছে তৃণমূল। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের নতুন সভাপতি হলেন সুভাষ ভাওয়াল। আগে সভাপতি ছিলেন মৃণাল সরকার। ওই জেলার চেয়ারম্যান করা হয়েছে কুমারগঞ্জের বিধায়ক তোরাফ হোসেন মণ্ডলকে। ওই পদে ছিলেন নিখিল বর্মণ। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক সাংগঠনিক জেলায় সভাপতির পদ থেকে সরানো হয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রকে। তাঁকে দলের রাজ্য সম্পাদক করা হয়েছে। তাঁর জায়গায় আনা হয়েছে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেখানে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে নন্দীগ্রাম জমি আন্দোলনের নেতা পীযূষ ভুঁইয়াকে। নতুন চেয়ারম্যান হয়েছেন চিত্ত মাইতি। রদবদল হয়েছে কাঁথি সাংগঠনিক জেলাতেও। জেলা সভাপতি ছিলেন তরুণ মাইতি। তাঁকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন সভাপতি হয়েছেন পীযূষকান্তি পণ্ডা। আগের চেয়ারম্যানের মৃত্যু হওয়ায় তরুণকে সেই দায়িত্ব দিয়েছে তৃণমূল। এই দুই জেলায় তিনটি লোকসভা আসন। ফলে এই বদলও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy