পুলিশ হেফাজত হওয়ায় কেঁদে ফেললেন পাঁচুবাবু। বারুইপুর আদালত চত্বরে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
দিনের আলোয় দলেরই লোককে খুন করানোর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। তার পরেও ভাঙড় আছে আরাবুল ইসলামের হাতেই! গা ঢাকা দেওয়া তো দূরের কথা, আরাবুল নিজে থানায় বসে চা-বিস্কুট সহযোগে পুলিশ-প্রশাসনকে কার্যত চালনা করেছেন বলে অভিযোগ! নিহত রমেশ ঘোষালের পরিবারই বরং আতঙ্কে ঘরছাড়া। যাঁকে মারতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলিতে বাপন মণ্ডল নিহত হয়েছেন বলে দাবি, বাপন-হত্যায় সেই পাঁচু মণ্ডলকেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
দলে আরাবুলের বিরোধী গোষ্ঠীর সদস্য বলে পরিচিত ছিলেন রমেশ। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, তাঁরা পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাঁদের কথাকে গুরুত্ব দেয়নি। রমেশের খুড়তুতো ভাই রঞ্জিত ঘোষাল রবিবার সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, শনিবার যখন তাঁরা এফআইআর করতে গিয়েছিলেন, থানায় উপস্থিত ছিলেন আরাবুল। তিনি ধমক দিয়ে চাপ দিতে থাকেন, যাতে হত্যাকারী হিসেবে প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান পাঁচু মণ্ডলের নাম লেখা হয়। রঞ্জিত রাজি না হওয়ায় পুলিশ তাঁকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেয় বলে অভিযোগ। ঠিক যে অভিযোগ উঠেছিল বীরভূমের পাড়ুইয়ে হৃদয় ঘোষ হত্যা মামলাতেও।
পুলিশ-প্রশাসনের একাংশও স্বীকার করছেন, আরাবুল ও তাঁর মোটরবাইকবাহিনীর চাপেই সাদা কাগজে সই করতে হয়েছে নিহতের পরিবারকে। তারই ভিত্তিতে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে রমেশবাবুকে খুন করার লিখিত অভিযোগ গৃহীত হয়েছে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানায়। শনিবার দুপুর নাগাদ থানায় আসেন রমেশবাবুর স্ত্রী আশা ও মেয়ে পারমিতা। আশাদেবীর অভিযোগ, “আরাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাতে না করা হয়, সেই বিষয়ে একাধিক অফিসার আমাদের ধমক দিয়েছিলেন। পরে আরাবুল এসেও আমাদের হুমকি দিতে থাকে।” সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে রাত পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রাখা হয় তাঁদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশেরই বক্তব্য, আরাবুলের নির্দেশ মতোই কাজ করছে পুলিশ। যদিও আরাবুল দাবি করেছেন, “আমার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগই মিথ্যা।”
এত কিছুর পরে অবশ্য এলাকায় থাকতে ভরসা পায়নি রমেশবাবুর পরিবার। রবিবার রমেশবাবুর মেয়ে ফোনে বলেন, “আমরা এক আত্মীয়ের বাড়িতে রয়েছি। ওখানে ফিরে গেলে আমাদেরও মেরে ফেলবে আরাবুলের বাহিনী। পুলিশ তো ওদের সঙ্গেই রয়েছে।”
চোখের সামনেই স্বামী ও ছেলেদের ভ্যানে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ।
মহিলা পুলিশকর্মীর পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পাঁচু
মণ্ডলের স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী। রবিবার। ছবি: সামসুল হুদা।
স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের বড় অংশের অভিযোগ, কার্যত পুলিশের সামনেই রমেশের উপরে আক্রমণ চালিয়েছিল আরাবুল অনুগামীরা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী-সহ পদস্থ কর্তাদের দাবি, সঙ্গে শুধু লাঠি থাকায়, দুষ্কৃতীদের মোকাবিলা করা যায়নি। কিন্তু এলাকার এক পুলিশ অফিসারের স্বীকারোক্তি হলো, আরাবুলের নির্দেশই ভাঙড়ে এখনও শেষ কথা! পুলিশের হাত-পা বাঁধা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও মন্তব্য করেননি এসপি। ফোন ধরেননি, এসএমএসেরও জবাব দেননি। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার বলেন, “এই ধরনের কোনও বিষয় আমার জানা নেই।”
শুধু রমেশ-হত্যা নয়, বাপন খুনের মামলাও আরাবুল নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ! আরাবুল এবং তাঁর অনুগামীরা থানায় বাপনের মা চৈতালীদেবীকে নিয়ে এসেছিলেন। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, রমেশবাবুর পরিবারের মতোই তাঁর কাছ থেকেও একটা সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছেন কর্তব্যরত অফিসাররা। তার পরে ওই কাগজে পাঁচুবাবু ও তাঁর দুই ছেলে-সহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন বামনঘাটা এলাকার বাসিন্দা যুব তৃণমূলের এক নেতা। তখন থানায় বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছিলেন আরাবুল! পুলিশ সূত্রের খবর, রাত ১০টা নাগাদ ফের থানায় আসেন আরাবুল। সাড়ে ১১টা নাগাদ ফিরে যান। এর পরেই পাঁচু ও তাঁর দুই ছেলে রণজিৎ ও তাপসকে ধরে নিয়ে আসা হয়। আদালত এ দিন তাঁদের তিন জনকেই পাঁচ দিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
যদিও এলাকাবাসীরাই জানাচ্ছেন, রমেশ খুনের পরে পাঁচু মণ্ডলের বাড়িতেই চড়াও হয়েছিল দুষ্কৃতীরা। পাঁচুবাবুর দাবি, তিনি ওই সময় ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। দুষ্কৃতীরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। সেই গুলিতেই নিহত হন বাপন। ওই দিন বিকেলে থানায় অভিযোগ করতে এসেছিলেন পাঁচুবাবু ও তাঁর দুই ছেলে। পাঁচুবাবুর অভিযোগ, থানার বাইরেই তাঁদের আটকে দেয় আরাবুলের বাহিনী। প্রাণের ভয় দেখিয়ে তাঁদের থানা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই সময়েও থানার ভিতরে বসেছিলেন আরাবুল ও ঘনিষ্ঠ কয়েক জন অনুগামী।
এর পরেই পাঁচুবাবু সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে আরাবুলের নির্দেশে মিথ্যা মামলা তৈরি করছে পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন করছি, আপনি আমাদের আরাবুলের হাত থেকে বাঁচান।” পাঁচুবাবু বাঁচেননি, তাঁকে গ্রেফতার হতে হয়েছে। রবিবার সকালে যখন আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্যানে তোলা হচ্ছে পাঁচুবাবুদের, পুলিশের পা জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেন পাঁচুবাবুর স্ত্রী লক্ষ্মী মণ্ডল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “আরাবুলের দুষ্কৃতীরা গুলি চালাল। অথচ পুলিশ আমার স্বামী-ছেলেদের নামে মামলা করল। আমাদের কোনও অভিযোগ দায়ের করতে দিল না।”
অভিযুক্ত পাঁচু মণ্ডলের ছোট ছেলে তাপস মণ্ডল। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
কী ভাবে এমন অবাধে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন আরাবুল? ভাঙড়ের ঘটনার পরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ ছিল, কাউকে রেয়াত করা হবে না। দলীয় স্তরে তৃণমূল নেতৃত্বও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কোনও প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল ভবনে বসে রাজ্যের মন্ত্রী তথা দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য রবিবারও বলেছেন, “দল কোনও অবস্থাতেই হিংসাকে প্রশ্রয় দেবে না। আমাদের দলের কেউ যুক্ত থাকলে, তাকেও ছাড়া হবে না!”
তা হলে আরাবুলের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে দল? পার্থবাবুর জবাব, “শুধু আরাবুল কেন, সব ক’টা নাম নিয়েই আলোচনা হয়েছে। আমরা কী পদক্ষেপ করব, তা দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পদক্ষেপ করা হলে, জানানো হবে।” শোনা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতৃত্ব আরাবুলের উপরে সত্যিই অসন্তুষ্ট। কারণ, আরাবুলের জন্য দলের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হচ্ছে। কিন্তু তা হলে ভাঙড়ের ছবিটা বদলাচ্ছে না কেন? হুঁশিয়ারি কি তবে কেবলই দলীয় নেতৃত্বের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে?
ভাঙড় থেকে যে আরাবুল হাজার হাজার ভোটের ‘লিড’ দেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কি সমস্যা হচ্ছে? ভাঙড়বাসীর আশঙ্কা কিন্তু তেমনটাই। ভাইফোঁটার দিন এমন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে এলাকায় যথেষ্ট উত্তেজনা রয়েছে। সে কারণে পুলিশ রমেশবাবু এবং বাপনের মৃতদেহ ভাঙড়ে আনার ঝুঁকি নেয়নি। কলকাতাতেই তাঁদের সৎকার করা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy