Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দুর্গ সাজিয়েও নাজেহাল পুলিশ

বড় মিছিল হবে জানা ছিল পুলিশের। তাদের এ-ও জানা ছিল, বামেদের এই মিছিলের সুর থাকবে চড়া। সেই অনুযায়ী, দুর্গ সাজিয়েছিল তারা। কলকাতা ও হাও়ড়ায় খান পাঁচেক ব্যারিকেড করেছিল এই আশায়, নবান্নের দু’-তিন কিলোমিটার আগেই থমকে যাবেন আন্দোলনকারীরা।

অভিযানকারীদের বাধা দিতে প্রস্তুত পুলিশ।

অভিযানকারীদের বাধা দিতে প্রস্তুত পুলিশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

বড় মিছিল হবে জানা ছিল পুলিশের। তাদের এ-ও জানা ছিল, বামেদের এই মিছিলের সুর থাকবে চড়া। সেই অনুযায়ী, দুর্গ সাজিয়েছিল তারা। কলকাতা ও হাও়ড়ায় খান পাঁচেক ব্যারিকেড করেছিল এই আশায়, নবান্নের দু’-তিন কিলোমিটার আগেই থমকে যাবেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না!

বৃহস্পতিবার ভরদুপুরে কলকাতা-হাওড়ায় একযোগে পাঁচ-ছ’টি জায়গায় পুলিশ বনাম বাম-বিক্ষোভকারীদের খণ্ডযুদ্ধ চরম আকার নিল। আর তাতেই বেআব্রু হয়ে গেল পুলিশের অপ্রস্তুত দশা। মধ্য কলকাতা ও হাওড়া জুড়ে চরম বিশৃঙ্খলার আবহে বিপর্যস্ত হল জনজীবন। কাজের দিনে গোটা দুপুর জুড়ে মধ্য কলকাতা ও হাওড়া কার্যত অবরুদ্ধ তো ছিলই। বিক্ষোভের দরুণ রেসকোর্সের হেলিপ্যাড থেকে রাজভবন পৌঁছতে শহরে আগত উপ-রাষ্ট্রপতিকেও ঘুরপথ ধরতে হল!

কলকাতা ও হাওড়ার বিভিন্ন দিক থেকে বামেদের কৃষকসভার নবান্নমুখী মিছিলগুলি যে এক সঙ্গে এমন জঙ্গি হয়ে উঠবে, তা আঁচই করেননি লালবাজার ও হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারা। তাই প্রয়োজনে বেধড়ক লাঠি চালিয়েও পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে সামলানো যায়নি। সংবাদ চ্যানেলের ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ইটবৃষ্টির সামনে পিছু হটছে পুলিশ। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র পরে স্বীকার করেন, ‘‘পরিস্থিতি সামলাতে আমরা লাঠি চালিয়েছি। তবে প্ররোচনার মাত্রা অনুযায়ী পুলিশ সংযতই ছিল বলা যায়।’’ পরে তিন বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশকে নিগ্রহের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

পুলিশ কর্তাদের বয়ান শুনে বামেদের পাল্টা দাবি, মিছিল করতে গিয়ে তাঁরাই আক্রান্ত। অন্তত ১৫৬ জন বাম সমর্থক আহত হয়েছেন। মাথায় ইটের আঘাত লেগেছে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর। মিছিলে সামিল বছর উনিশের চন্দন রায় গুরুতর জখম হয়ে আন্দুলের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁকে আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে। পিডিএসের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সংগঠনের নেত্রী অপর্ণা নস্কর পা ভেঙে জখম হয়েছেন। পুলিশের দাবি, এসএসকেএম, সিএমআরআই এবং বেলভিউ মিলিয়ে ২৯ জন পুলিশকর্মীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছ’জনের অবস্থা গুরুতর। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় ফিরে বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসএসকেএমে আহত পুলিশকর্মীদের দেখতে যান। রাতে লালবাজারের বিশেষ কমিশনার (২) সৌমেন মিত্র, যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) সুপ্রতিম সরকারও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার আগে অবশ্য সাংবাদিক
বৈঠকে সুপ্রতিমবাবু হামলার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘মিছিলকারীরা শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক ছিলেন। ওঁরা ব্যাগে করে পাথরও এনেছিলেন। বিনা প্ররোচনায় তা ছুড়তে থাকেন।’’ পুলিশের দাবি, ডিসি (উত্তর) শুভঙ্কর সিংহ সরকার, ডিসি (দক্ষিণ) মুরলীধর শর্মা, হাও়ড়ার ডিসি (সদর) রণেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ কর্তারাও জখম হয়েছেন।

যাবতীয় বিশৃঙ্খলার জন্য বিক্ষোভকারীরাই দায়ী বলে দাবি করে লালবাজারের কর্তারা এ দিন নিজেদের ক্যামেরায় তোলা ছবি ও এবিপি আনন্দের ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখান। যুগ্ম-কমিশনার (সদর)-এর দাবি, ‘‘কারা ইট ছুড়েছেন, তা
বোঝা গিয়েছে।’’

তবে এত কিছু করেও পুলিশের মুখ যে পুড়েছে, তা পরিষ্কার। নবান্নের চারটে গেটই বন্ধ রাখা ছিল। ছিল কড়া নিরাপত্তাও। তার মধ্যেই মন্দিরতলার দিক থেকে নবান্নের ৫০ মিটারের মধ্যে চলে আসে শ’দেড়েক লোকের একটি মিছিল! এক পুলিশকর্তা হাতজোড় করে তাঁদের নিরস্ত করেন।

কাকুতি-মিনতি অবশ্য সব সময় কাজে আসেনি! সাঁতরাগাছি স্টেশনের কাছে অ্যালুমিনিয়ম প্লেটের মজবুত ব্যারিকেডও ভেঙে ফেলে জনতা। স্লোগান ওঠে, ‘পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো, তৃণমূলের ঝান্ডা ধরো’! ডাফরিন রোডে এক সময়ে দেখা যায়, ব্যারিকেডের সামনে ইট বৃষ্টিতে পিছু হটা পুলিশই পিছনে ঘুরে জনতার উদ্দেশে ইট ছুড়ছে! সেখানেই বিমান বসুর মাথায় ইট পড়ার ঘটনা ঘটে। বাম সমর্থকদের কারও কারও মাথা ফেটে রক্তারক্তি দশাও টিভি-র ফুটেজে ধরা
পড়েছে। পুলিশকে অনেক ক্ষেত্রেই নির্বিচারে লাঠি চালাতেও দেখা গিয়েছে। হাওড়ায় কোনা এক্সপ্রেসওয়ের উপরে হ্যাংস্যাং মোড়ের কাছে পুলিশের লাঠি থেকে রেহাই পাননি মহিলারাও।
হেস্টিংসে সুজন চক্রবর্তী ধাক্কাধাক্কিতে চোট পেয়েছেন। হাতে লাঠি লেগেছে সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যাপাধ্যায়ের।

আবার উল্টো ছবিও ছিল। ডাফরিন রোডে পুলিশ-কর্তা সৌমেন মিত্রকে বাঁশ দিয়ে পেটানোর অভিযোগ তুলেছে পুলিশই। ডিসি (নর্থ)-এর বুকে ইট লাগার অভিযোগও উঠেছে। হেস্টিংসে দেখা গিয়েছে, এক মহিলা পতাকার ঝান্ডা খুলে পুলিশকে পেটাচ্ছেন। হাওড়ার ফোরশোর রোডে দেখা যায়, লোহার পাইপ, বাঁশের বাড়ি মেরে ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশকে বড় বড় পাথর, ইট, জুতো ছুড়ছেন বিক্ষোভকারীরা।

পুলিশের দাবি, সাঁতরাগাছিতে তাঁদের কর্মীদের বাঁশ দিয়ে পেটানো হয়েছে। পুলিশকে লক্ষ করে বোমাও পড়েছে। পুলিশের গাড়ি, রাস্তার ধারের হোটেল ভাঙচুর করা হয়। হাওড়ায় জলকামান, অন্তত ২০ রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসেও পরিস্থিতি সামলানো যায়নি। কলকাতায় অবশ্য জলকামান, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করা হয়নি। শেষমেশ কোনা এক্সপ্রেসওয়ে, ডাফরিন রোডে অবস্থান সমাবেশে বসে পড়ে জনতা।

দুপুরে হাওড়া ও কলকাতায় যাতায়াত কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। অফিস পাড়া থেকে গাড়িতে শিবপুরে যাচ্ছিলেন সুতনু বিশ্বাস। দুপুর একটার পরে অফিস থেকে বেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে ঝাড়া তিন ঘণ্টা সময় লাগে তাঁর! পরে তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে ধর্মতলা থেকে বাবুঘাটের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। প্রিন্সেপ ঘাটে এক ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে। এর পরে পুলিশ বিদ্যাসাগর
সেতুতে উঠতে না-দিলে খিদিরপুর মোড়ে চলে যেতে হয়। শেষমেশ ঝামেলা মিটতে বিদ্যাসাগর সেতুতে উঠি। তখন চারটে বেজে গিয়েছে।’’ বিকেলে উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারিকে রেসকোর্সের কাছ থেকে ফারলং গেট, স্ট্র্যান্ড রোড
হয়ে রাজভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

দুপুর থেকে কয়েক ঘণ্টার জন্য মহাত্মা গাঁধী রোড, ব্রেবোর্ন রোড, রবীন্দ্র সরণি, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, জওহরলাল নেহরু রোড, ধর্মতলা, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, লেনিন সরণি, এস এন ব্যনার্জি রোড, বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, স্ট্র্যান্ড রোড-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা থমকে যায়। হাওড়ায় মিছিলের জন্য ফোরশোর রোডের যানবাহন হাওড়া কোর্টের সামনে থেকে হাওড়া ময়দানের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। সন্ধের পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE