ধৃত চার তৃণমূলকর্মীর মধ্যে দু’জন। (ডান দিকে) ধৃত বিজেপির দুই কর্মী। সিউড়ি আদালতে।—নিজস্ব চিত্র।
এক থানা। দুই অভিযোগ। একটা তৃণমূলের। অন্যটি বিজেপি-র। দুই অভিযোগের মোটামুটি একই বয়ান। প্রথমটিতে অভিযোগকারীর বক্তব্য, গুলি-বোমা চালিয়ে তাঁকে এবং অন্যদের জখম করেছে তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী। এর ঠিক কুড়ি মিনিট পরেই দায়ের হওয়া দ্বিতীয় এফআইআরে অভিযোগকারীর দাবি, তাঁদের কয়েক জনকে প্রাণে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে বোমা-গুলি নিয়েই পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ চালিয়েছে বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা।
বুধবার পাড়ুই থানার ইমাদপুরে ওই সংঘর্ষের ঘটনায় ধৃত বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা (৩০৭ ধারা) করল পুলিশ। আর একই ঘটনায় ধৃত তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে রুজু হল মারধরের মামলা! যা দেখে বিজেপি বীরভূম পুলিশের বিরুদ্ধে ফের রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। বিরোধীদের একাংশ আবার বলছেন, এ যেন সেই ‘রায়গঞ্জে বেল, মাজদিয়ায় জেল’-এরই পুনরাবৃত্তি! রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যক্ষ নিগ্রহে অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারা প্রয়োগ করেছিল পুলিশ। অন্য দিকে, নদিয়ার মাজদিয়ার কলেজে একই কাণ্ডে অভিযুক্ত এসএফআই সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছিল জামিন-অযোগ্য ধারায়। “পাড়ুইয়ের ঘটনা ফের প্রমাণ করল, তৃণমূলের শাসনে সেই ট্র্যাডিশনই অব্যাহত আছে।”মন্তব্য রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার।
বীরভূমের পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার প্রতিক্রিয়া, “এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। এটুকু বলতে পারি, অভিযোগের ভিত্তিতেই পুলিশ ধারা প্রয়োগ করেছে।” যদিও ধৃত বিজেপি কর্মীদের আইনজীবী সুকুমার ঘোষ বলেন, “দু’টি অভিযোগেরই মূল সুর, খুনের চেষ্টা। বুঝতে না পারার কোনও কারণ নেই। তার পরেও ইমাদপুর-কাণ্ডে পুলিশ দু’পক্ষের ধৃতদের বিরুদ্ধে যে ধারা দিয়েছে, তাতে পক্ষপাত করা হয়েছে। ঘটনায় দু’পক্ষের লোকই জখম হয়েছেন। তা হলে দু’পক্ষের দায়ের হওয়া মামলায় একই ধারা প্রয়োগ করা উচিত ছিল।” তাঁর অভিযোগ, বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা হলেও ধৃত তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে তুলনায় ‘লঘু’ ধারায় মামলা করা হয়েছে। এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি সরকারি আইনজীবী কুন্তল চট্টোপাধ্যায়।
বুধবার পাড়ুই বাজার সংলগ্ন মাঠে সভা করেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। সভায় আসার পথে ইমাদপুরে বিজেপি কর্মীদের উপরে গুলি-বোমা নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। গুলি ও বোমায় আহত হন ছ’জন বিজেপি কর্মী-সমর্থক। তৃণমূলের পাল্টা দাবি, ইমাদপুর গ্রাম দখলের লক্ষ্যে বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই হামলা চালিয়েছিল। তাদের আক্রমণে আহত হন তিন জন তৃণমূল কর্মী। বুধবার রাতেই প্রথমে বিজেপি এবং পরে তৃণমূলের পক্ষে পৃথক দু’টি এফআইআর হয়।
ঠিক কী ছিল দু’টি অভিযোগে?
হরিশপুরের জখম বিজেপি কর্মী শেখ আনারুলের দায়ের করা অভিযোগে লেখা হয়েছে, গাড়িতে চেপে সভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে দুপুর ২টো নাগাদ ইমাদপুরের কাছে তৃণমূল নেতা মোস্তাক হোসেন এবং সিরাজুল শা-র নেতৃত্বে তৃণমূলের হার্মাদ বাহিনী বোমাবাজি শুরু করে। গুলিও চলে। ওই এফআইআর-এ আনারুলের অভিযোগ, ‘এতে আমি গাড়ির মধ্যে গুলিবিদ্ধ হই ও আমাদের কয়েক জন বোমাবাজিতে আহত হয়’। আনারুল ৪০ জন তৃণমূল নেতা-কর্মীর নামে অভিযোগ করেছেন।
দ্বিতীয় অভিযোগটি করেছেন ইমাদপুরের তৃণমূল কর্মী জন্মেজয় মুখোপাধ্যায়। অভিযোগপত্রে তিনি লিখেছেন, দুপুর আড়াইটেতে ২০০-২৫০ জন বহিরাগত দুষ্কৃতী বোমা, বন্দুক, মাস্কেট, টাঙ্গি নিয়ে গ্রামে ঢুকে ‘আমাদের প্রাণে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ করে’। ওই এফআইআরে ৪২ জন বিজেপি নেতা-কর্মীর নাম আছে।
রাতেই পুলিশ ইমাদপুরের চার তৃণমূল কর্মী দিলীপ ডোম, পতিতপাবন ডোম ও পঞ্চানন বায়েন, নারায়ণ ডোম এবং হরিশপুরের দুই বিজেপি কর্মী শেখ সানাউল্লাহ ও শেখ নুর আলমএই ছ’ জনকে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার সিউড়ি আদালতে তোলা হলে ধৃতদের পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়।
অস্ত্র আইন-সহ কিছু ধারা ধৃত ছ’জনের ক্ষেত্রেই থাকলেও বিজেপি-র দুই কর্মীর বিরুদ্ধে আলাদা ভাবে খুনের চেষ্টার ধারা দেওয়ায় জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। দলের বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের অভিযোগ, “পাড়ুই নিয়ে তৃণমূলের বহু দিনের মাথাব্যথা। সেখানকার পুলিশ যাতে তৃণমূলের কথায় চলে, তার জন্যই তো ঘনঘন ওসি বদল হচ্ছে। এবং বিজেপি কর্মীদের এ ভাবে মিথ্যা মামলায় শক্ত ধারায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” তাঁর চ্যালেঞ্জ, “দেখি, কত ধারা ওরা প্রয়োগ করতে পারে। কোনও লাভ হবে না!”
তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ফোন ধরেননি। তবে, বিভিন্ন মামলায় তৃণমূলের হয়ে লড়া আইনজীবী তথা দলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “মাখড়া-কাণ্ডে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দায়ের করা মামলায় পুলিশ কিন্তু খুনের ধারা (৩০২) দেয়নি। কেবল খুনের চেষ্টার ধারা দিয়েছিল। অথচ সেখানে তিন জন খুন হয়েছিলেন। তখন তো কেউ প্রশ্ন তোলেননি?” তাঁর বক্তব্য, “আমরাও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি। পুলিশকে পুলিশের কাজ করতে দিয়েছি। পুলিশ পরে খুনের মামলা দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও আবেদনের ভিত্তিতে পরে ৩০৭ ধারা যুক্ত করা যেতেই পারে। এটা নিয়ে এত হইচই করার কী আছে!”
জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, কাল, শনিবার ইমাদপুরেই বিজেপি-র পাল্টা সভা করবেন অনুব্রত মণ্ডল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy