Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

দেগে দেওয়ার আতঙ্কেই সায় আন্দোলনে

এই ‘দেগে দেওয়া’র ভয়ই এখন ছেয়ে রয়েছে দার্জিলিং পাহাড়। মোর্চার কট্টরপন্থী অংশটিতে রয়েছেন যুব মোর্চার কর্মীরা। তাঁদেরই ভয় পাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ।

প্রতিবাদ: চকবাজারে নিজেদের পিঠে টিউবলাইট ভেঙে বিক্ষোভ দেখালেন মোর্চা সমর্থকেরা। নিজস্ব চিত্র

প্রতিবাদ: চকবাজারে নিজেদের পিঠে টিউবলাইট ভেঙে বিক্ষোভ দেখালেন মোর্চা সমর্থকেরা। নিজস্ব চিত্র

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৭ ০৩:২০
Share: Save:

একের পর এক যুবকের পিঠে ভাঙছে টিউবলাইট। আর দার্জিলিঙের চকবাজারে সেই দৃশ্য দেখে শিউরে শিউরে উঠছিলেন আশেপাশের বেশ কয়েকজন পাহাড়বাসী। এঁদের অনেকেই আশপাশের গ্রাম থেকে দার্জিলিঙে এসেছিলেন কিছু খাবার কেনার আশায়। উদ্বিগ্ন মুখে মঙ্গলবার তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার পথে এক জন আর এক জনকে বলছিলেন, ‘‘আরও কত দূর যাবে, কে জানে। দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছে।’’

কিন্তু মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। বুধবার যে কিশোরদের খালি গায়ে শিকল পরিয়ে হাঁটানো হয়েছে, তাদের পাশে পাশে যাচ্ছিলেন পরিবারের লোকজন। তাঁদেরও কয়েকজনের মুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ ছিল। এক রকম বাধ্য হয়েই ছেলেকে পাঠিয়েছেন মোর্চার আন্দোলনে। এক মহিলা বললেন, ‘‘পাশের বাড়ির ছেলে গিয়েছে, আমার ছেলে না গেলে যদি আমাদের গোর্খাল্যান্ড বিরোধী বলে দেগে দেওয়া হয়! সেই আতঙ্কে নিজে থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে পাঠিয়েছি।’’

সমতলে কাজ করেন এমন পুলিশ অফিসারও ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল কালো করে রেখেছেন। বলছেন, ‘‘পরিবার পাহাড়ে। যদি কিছু হয়ে যায়, কী করে বাঁচাবো? তাই আমিও যে গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে, তা বোঝাতে চেয়েছি।’’

এই ‘দেগে দেওয়া’র ভয়ই এখন ছেয়ে রয়েছে দার্জিলিং পাহাড়। মোর্চার কট্টরপন্থী অংশটিতে রয়েছেন যুব মোর্চার কর্মীরা। তাঁদেরই ভয় পাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ।

ভরা পর্যটন মরসুমে মোর্চার আন্দোলনে প্রায় একশো কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে পাহাড়ে। ক্ষতির বহর আরও বাড়বে। তবু মুখ খোলার জো নেই। মোর্চার কট্টরপন্থী অংশটিতেও পাহাড়ের শহরের বাসিন্দাই বেশি। যখন যে শহরে আন্দোলন হচ্ছে, তখন যুব মোর্চার কর্মীরাই এগিয়ে আসছেন। কিন্তু পাহাড়ের গ্রামে আন্দোলন তেমন ছড়ায়নি বলে মোর্চার অন্দরেই খবর। মোর্চার এক নেতা জানান, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আন্দোলনের প্রচার বিঘ্নিত হচ্ছে। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পঙে কিছু হলে যাও বা তা প্রচার করা যাচ্ছে, গ্রামে তা সম্ভব নয়।

গ্রামের খবরও তাই তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের রোজগার বন্ধ। খাবার হিসেব করে খেতে হচ্ছে। সেই কারণেই গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে যে কোনও সময়ে ডাকলেই যে কোনও জায়গায় এক সময় যে কাতারে-কাতারে মানুষ জড়ো হতেন, সে ছবি আর দেখা যাচ্ছে না।

যে কারণে মরিয়া মোর্চা নেতারা জিএনএলএফ, গোর্খা লিগ, জন আন্দোলন পার্টি, গোর্খা রাষ্ট্রীয় নবনির্মাণ মঞ্চের মতো দলগুলিকে পাশে রাখতে মরিয়া। পাহাড়ের নাগরিক সমাজে এই দলগুলির প্রভাব রয়েছে। মোর্চার কট্টরপন্থী আন্দোলনে যাঁরা বিরক্ত, তাঁদেরও এই দলগুলির সাহায্যে একত্রিত করে রাখা যাবে বলে মনে করছেন বিমল গুরুঙ্গরা। পাশাপাশি, নতুন করে নির্বাচন যদি বা হয়ও, মোর্চার সঙ্গে থাকায় এই দলগুলি তাতে যোগ দিতে পারবে না। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক বিনয় তামাঙ্গের অবশ্য দাবি, ‘‘কোথাও ভয় দেখানো হচ্ছে না। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আন্দোলনে আসছেন।’’

মোর্চা নেতারা কিন্তু জানেন, দিন বদলেছে। পাহাড়ে শিক্ষার প্রসার হয়েছে। অনেকে দেশের নানা জায়গায় চাকরি সূত্রে থাকেন। তাঁদের মতে, লাগাতার আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত যে খুব মহার্ঘ কোনও ফল যে মেলে না, তা সেই জিএনএলএফের আমল থেকেই বারবার দেখা গিয়েছে। এমনই একজন বলেন, ‘‘পাহাড়ে তো উন্নতি হচ্ছে। আলাদা রাজ্যের জন্য দাবি না করে, আরও উন্নয়নের চেষ্টা করলে মোর্চা সাধারণ মানুষকে পাশে পেত।’’ তাই গোর্খাল্যান্ডের জন্য লড়াইয়ে নেমে পাহাড়ের মানুষের সঙ্গেও লড়তে হচ্ছে মোর্চাকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE