ভাঙড়ে সংঘর্ষে নিহত রাজু নস্করের স্ত্রী রুমা ঘোষ নস্কর। — নিজস্ব চিত্র।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়-২ ব্লকের বামনঘাটা এলাকার বাসিন্দা রাজু নস্কর তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন অকালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০। সত্তরের দশকে রাজুর বাবা সুধীর নস্করের মৃত্যু হয়েছিল এক সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গুলি খেয়ে। বয়স যখন চল্লিশের ঘরে তখন রাজুরও অকালমৃত্যু হল সংঘর্ষেই। মাত্র ন’বছর বয়সেই পিতৃহারা হতে হল রাজুর পুত্র রমিতকে। পরিবারের সদস্যদের অকালমৃত্যুর এই কথা বলছেন প্রয়াত রাজুর স্ত্রী রুমা ঘোষ নস্কর। গত ১৪ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ভাঙড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ঘিরে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে তৃণমূল এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)-এর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। সেই সংঘর্ষেই মৃত্যু হয় তৃণমূল কর্মী রাজুর।
ওই সংঘর্ষে রাজুর মতো মৃত্যু হয়েছে রশিদ মোল্লা নামে আর এক তৃণমূল কর্মীর। তিনি জীবনতলার মৌখালির বাসিন্দা। মৃত্যু হয়েছে আইএসএফ সমর্থক মহিউদ্দিন মোল্লারও। ভাঙড়-২ ব্লকের চালতাবেড়িয়ার বাসিন্দা মহিউদ্দিন ছিলেন পরিবারের অন্যতম রোজগেরে। তাঁর মৃত্যুতে বিপাকে পড়েছে পরিবার। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে ২২ দিন। কিন্তু ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হননি। এমনই অভিযোগ করলেন তাঁর কাকা সালাউদ্দিন মোল্লা। তাঁর কথায়, ‘‘এত দিন কেটে গেল কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয়নি। বহু জায়গায় জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। উল্টে আমাদের ভয় দেখানো হচ্ছে।’’
এই পরিস্থিতিতে কী চান সালাউদ্দিন? প্রশ্ন শুনে তাঁর কাটা কাটা উত্তর, ‘‘আমরা শান্তি চাই। মহিউদ্দিন চলে যাওয়ায় পরিবারে অভাব বেড়েছে।’’ শনিবার ভোট। ভোট কি দিতে যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নেড়ে সালাউদ্দিন জানালেন, তিনি ভোট দেবেন। তবে প্রশাসনের কাছে তাঁর দাবি, ‘‘যে রক্তারক্তি দেখলাম তা যেন ভোটের দিন না হয়।’’
মহিউদ্দিনের মতো অবস্থা রাজুর পরিবারেরও। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই নাবালিকা মেয়ে এবং এক নাবালক ছেলেকে নিয়ে অনটন আর আশঙ্কার মধ্যেই দিন কাটছে রুমার। তিনি জানালেন, রাজু তেমন কোনও কাজ করতেন না। সংসার টানতেন রুমা। এক সময় লোকের বাড়িতে রান্না করে সংসার চালাতেন। রাজুর মৃত্যুর পর তৃণমূল-সহ অন্যান্য দলের তরফে কিছু আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন। সেই টাকাতেই এখন সংসার চলছে। কিন্তু এই অর্থ শেষ হলে? রুমার জবাব, ‘‘আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন নেতারা। তবে তাঁরা যদি কথা না রাখতে পারেন তা হলে আমার পুরনো পেশাতেই আবার ফিরে যাব।’’ ভোট দেবেন? রুমা বললেন, ‘‘ভোট দেব। তবে আর যেন রক্তারক্তি না হয়! আর কেউ যেন তাঁর স্বামীকে না হারান, তা সে তিনি যে দলেরই সমর্থক হন না কেন।’’
ভাঙড়ে মনোনয়ন পর্ব মিটেছে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে। ভাঙড়-১ পঞ্চায়েত সমিতির ২৭টি আসনই ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছে তৃণমূল। ভাঙড়-১ ব্লকের মোট ন’টি গ্রাম পঞ্চায়েত (তারদহ, চন্দনেশ্বর-১, চন্দনেশ্বর-২, সাকসর, বোদরা, দুর্গাপুর, নারায়ণপুর, প্রাণগঞ্জ এবং জাগুলগাছি গ্রাম পঞ্চায়েত)-এর সব আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল।
ভাঙড়-২ ব্লকে রয়েছে ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত। সেখানে কিছু জায়গায় লড়াইয়ের মুখে পড়তে হচ্ছে রাজ্যের শাসকদলকে। যদিও সেই ১০টি পঞ্চায়েতেরও অধিকাংশ দখল করতে চলেছে শাসকদল। যেমন বামনঘাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৯টি আসনের মধ্যে ১১টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। বেঁওতা-১ পঞ্চায়েতের ১৫টি আসনের আটটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী শাসকদল। বেঁওতা-২ পঞ্চায়েতে অবশ্য লড়াই হবে। তবে ওই পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের মধ্যে ৪টিই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে তৃণমূল। লড়াই হবে বাকি ১৪টি আসনে। আবার ভগবানপুর পঞ্চায়েতের ২৮টি আসনের মধ্যে ১০টি ইতিমধ্যেই জিতেছে তৃণমূল। লড়াই হবে বাকি ১৮টি আসনে। পোলেরহাট-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের মধ্যে ৮টি আসন জিতেছে তৃণমূল।
পোলেরহাট-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট ২৪টি আসনেই জমি রক্ষা কমিটির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হচ্ছে রাজ্যের শাসকদলকে। তবে শাঁখপুকুর পঞ্চায়েতের ৩০টি আসনের মধ্যে ১৪টি দখল করেছে তৃণমূল। বাকি ১৬টি আসনে লড়াই হবে। আইএসএফের ‘ঘাঁটি’ হিসাবে পরিচিত চালতাবেড়িয়া পঞ্চায়েতের ৩০টি আসনের মধ্যে ৯টি তৃণমূল জিতেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাকি ২১ আসনে তৃণমূলের লড়াই হবে আইএসএফের সঙ্গে। ভোগালি-১ পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের মধ্যে অর্ধেক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পেয়েছে তৃণমূল। বাকি ৯ আসনে লড়াই। ভোগালি-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮টি আসনের ১২টিতে জয়ী তৃণমূল। লড়াই হবে বাকি ছয় আসনে।
ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে রয়েছে ৩০টি আসন। তার মধ্যে ১৪টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছে তৃণমূল। বাকি ১৬টি আসনে হবে লড়াই। অথচ একটা সময়ে ভাঙড়ে দলের গোষ্ঠিকোন্দল মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছিল তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছেও। এর পর সেখানে বিশেষ পর্যবেক্ষক হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লাকে। মনোনয়ন পর্বেই ভাঙড়ে সংঘর্ষের ঘটনা সামনে আসতেই শওকতের সঙ্গে ভাঙড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্তকেও। ভাঙড়ে রাজনীতির কারবারিদের একাংশের বক্তব্য, পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে রাজ্যের শাসকদল।
ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির আসনে এ বারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। তাঁর দাবি, শান্তিপূর্ণ ভোট হবে এলাকায়। আরাবুলের দাবি, ‘‘রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে উন্নয়ন হয়েছে। তার থেকে বাদ যায়নি ভাঙড়ও। ভাঙড়ের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট, পানীয় জল থেকে আরম্ভ করে সব কিছুর উন্নয়ন হয়েছে।’’ ভাঙড়ের দুই ব্লক মিলিয়ে জেলা পরিষদে রয়েছে মোট ছ’টি আসন। তার প্রতিটিতেই লড়াই হবে এ বার।
আরাবুল উন্নয়নের দাবি করলেও, ভাঙড়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সরব স্থানীয় বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। তিনি বলেন, ‘‘প্রশাসন নিরপেক্ষ না হলে স্বচ্ছ ভাবে ভোট হওয়া সম্ভব নয়।’’ প্রশাসন যাতে নিরপেক্ষ ভাবে ভোট পরিচালনা করে তার দাবি তুলেছেন আইএসএফ বিধায়ক। মানুষ যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন তার দাবিও তুলেছেন নওশাদ।
নওশাদের সুর ভাঙড়ের সিপিএম নেতৃত্বের গলাতেও। সিপিএম নেতা তুষার ঘোষের অভিযোগ, ‘‘প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছে না। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে।’’ একই সুর জমিরক্ষা কমিটির নেতা মির্জা হাসানের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গায় আমাদের প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কর্মী-সমর্থকদের ভয় দেখানো হচ্ছে। এ নিয়ে পুলিশকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না।’’
বিরোধী, বিশেষ করে আইএসএফের তোলা সন্ত্রাসের অভিযোগ মানতে নারাজ আরাবুল। উল্টে তিনি দাবি করেছেন, ‘‘আগামিদিনে ভাঙড়ের মাটিতে আইএসএফ করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না।’’ ঘটনাচক্রে, গত কয়েক দিন ধরে ভাঙড়ের আইএসএফ শিবিরে ভাঙন শুরু ধরেছে। দুই ব্লকের একাধিক জায়গায় নওশাদদের শিবির ছেড়ে অনেকেই যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে।
মনোনয়ন পর্বে তিন জনের মৃত্যুর পরেও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমেনি ভাঙড় জুড়ে। প্রায় প্রতি দিনই অশান্তির ঘটনা ঘটছে দুই ব্লকের বিভিন্ন জায়গায়। রয়েছে পুলিশি তল্লাশিতে আগ্নেয়াস্ত্র এবং বোমা উদ্ধারের ঘটনাও। এই আবহে ভোটের দিন শান্তি চাইছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত ১৪ জুন তৃণমূল ও আইএসএফের মধ্যে বোমাবাজি এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বিজয়গঞ্জ বাজার। সেই বাজারেই ছোট দোকান রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দা অমিত মণ্ডলের। তিনি বলেন, ‘‘সে দিন যা দেখেছি তা আবার হোক তা কখনওই আমরা চাই না। এলাকা শান্তিপূর্ণ থাকুক। মানুষ নির্ভয়ে কাজকর্ম করুক।’’ অমিত যাই চান, ভোটের দিন অশান্তির আশঙ্কা কুরে কুরে খাচ্ছে তিন জনের মৃত্যু দেখা ভাঙড়কে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy