(বাঁ দিকে) মনসুর আলম। মনসুরের পরিবারের সদস্যেরা (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।
সিপিএম কর্মী মনসুর আলমের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। কিন্তু তাঁর পরিবারের দিন আর কাটছে না! শনিবার পঞ্চায়েত ভোট। সে ভোটে অংশ নিতে পারবে না মনসুরের পরিবার। কারণ, জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরের সব আসনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গিয়েছে শাসক তৃণমূল।
ভোট নেই মনসুরের পরিবারের। কিন্তু মনসুরের মর্মান্তিক পরিণতির ভাবনা আছে। সে কথা ভেবেই দিন কাটছে তাঁর পরিবারের। পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিএম প্রার্থীর হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে মাথায় গুলি লেগে মৃত্যু হয়েছিল মনসুরের। তাঁর দাদু গিয়াসুদ্দিন বলছিলেন, ‘‘ও যে দিন মারা গেল, সে দিন থেকেই আমরা মর্মাহত। এখানে ভোট নেই। ও-ও আর নেই। কিন্তু ওর কথা ভেবেই দিন কাটছে আমাদের।’’
চোপড়া ব্লকের গেন্দাগছ গ্রামে থাকে মনসুরের পরিবার। গত ১৫ জুন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়ে সংঘর্ষ বেধেছিল চোপড়ার দাসপাড়া-কাঁঠালবাড়ি এলাকায়। বাম এবং কংগ্রেস শিবিরের অভিযোগ, সেই সংঘর্ষে মাথায় গুলি লেগেছিল মনসুরের। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে। ২০ জুন রাতে মৃত্যু হয় তাঁর। মনসুরের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে দিন পনেরো। কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যদের শোক থিতিয়ে যায়নি। এলাকার পরিস্থিতি কেমন জানতে চাওয়ায় চাপা স্বরে মনসুরের দাদু গিয়াসুদ্দিন আলম বললেন, ‘‘চোপড়া এখন থমথমে। মানুষের মনে হতাশা। কখন কী হবে তা নিয়ে আশঙ্কায় সকলে।’’ কেন, তারও উত্তর গিয়াসুদ্দিন দিলেন চাপা গলাতেই, ‘‘এলাকায় অনেককে দেখছি বোমা-বন্দুক হাতে ঘুরতে। আমাকে ওদের অনেকে বলছে, কেস হবে না। তোমরা কিছু করতে পারবে না। এমন নানা হুমকি দিচ্ছে আমাদের।’’ আশ্চর্য নয় যে, মনসুরের মৃত্যুর সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন তিনি।
পঞ্চায়েত ভোটের বিন্দুমাত্র আঁচ নেই চোপড়ায়। কারণ, অনেক আগেই চোপড়া বিজয় সেরে ফেলেছে তৃণমূল। গোটা চোপড়া জুড়ে কোথাও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে বিরোধীদের উপস্থিতি নেই। ব্লকে মোট ৮টি পঞ্চায়েত। তার ২১৭টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন তৃণমূল প্রার্থীরা। পঞ্চায়েত সমিতির ২৪টি আসন এবং জেলা পরিষদের তিনটি আসনও শাসকদলের দখলে।
১৫ জুনের স্মৃতি এখনও টাটকা মনসুরের কাকা জাকির হুসেনের মনে। তিনি বললেন, ‘‘ওই দিন মিছিলে আমিও ছিলাম। মার খেয়েছি। ওরা ভোট করতে দেয়নি। আর ওরা এখন এলাকায় বিজয়মিছিল করছে।’’ ‘ওরা’ মানে? জাকিরের অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের মদতে এলাকা দাপাচ্ছে ৩০০-৪০০ গুন্ডা। তাঁর আরও অভিযোগ, বাইক নিয়ে এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃণমূলের ওই ‘বাহিনী’। মনসুরের দাদু গিয়াসুদ্দিনের আশঙ্কা, ‘‘ভোটের ফল ঘোষণার পর আবার হয়তো অশান্তির পরিবেশ তৈরি হবে এলাকায়।’’
মনসুরের বাবা মইনুল হক, মা মনসুরা বিবি। চাষবাস করেই সংসার চলে তাঁদের। মইনুল স্বল্পভাষী। ছেলের মৃত্যু নিয়ে বিশেষ কথা বলতে চান না। মা মনসুরার কাছে অকালমৃত ছেলে মনসুরের কথা জানতে চাইতেই মুখে আঁচল চাপা দিলেন তিনি। তবে মুখ খুললেন গিয়াসুদ্দিন। বললেন, ‘‘আমার ৬১ বছর বয়স হয়ে গেল। কিন্তু চোপড়ায় এমন পরিস্থিতি কোনও দিন দেখিনি। বাম আমলেও কংগ্রেসের দখলে ছিল পঞ্চায়েত। আমার নাতি হকের দাবিতে গিয়েছিল। কিন্তু ওকে গুলি করে খুন করা হল!’’
সিপিএমের দাবি, পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকেই চোপড়ার ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত— সোনারপুর, হপতিয়াগছ, মাঝিয়ালি,দাসপাড়া, ঘিরনিগাঁও, লক্ষ্মীপুর, চুটিয়াখোর এবং চোপড়া অশান্ত হয়ে উঠেছিল। গোটা ব্লক জুড়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদলের জয় নিয়ে সিপিএম এবং কংগ্রেস শিবিরের ব্যাখ্যা, উত্তর দিনাজপুরের ৩০টিরও বেশি চা বাগান, পাহাড়ি নদীর বালি এবং পাথরের ব্যবসা ইত্যাদি দখলে রাখতেই শাসকদলের এই ‘আগ্রাসী’ মনোভাব। সিপিএমের চোপড়া এরিয়া কমিটির সম্পাদক বিদ্যুৎ তরফদারের কথায়, ‘‘লুটে-খাওয়া শ্রেণি ছাড়া চোপড়ার মানুষ হতাশ। মনে হচ্ছে পরাধীন দেশে বাস করছি।’’ তৃণমূলকে কাঠগড়ায় তুলে কংগ্রেস নেতা মসিরউদ্দিন মিয়ার অভিযোগ, ‘‘ওরা গায়ের জোর দেখিয়ে বিরোধীশূন্য করেছে! এই ব্লকে আগামিদিনে মানুষ সুযোগ পেলেই এর জবাব দেবেন।’’
বাম এবং কংগ্রেসের অভিযোগ শুনে চোপড়া তৃণমূলের ব্লক সভাপতি নাটু ঘোষের অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘বিরোধীদের যদি সংগঠন না থাকে, তবে তা তৈরি করে দেওয়ার দায়ও কি আমাদের?’’ তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যা, দাসপাড়া এবং ঘিরনিগাঁওয়ে ‘টিকে থাকা’ ছাড়া চোপড়া ব্লকের বাকি ছ’টি পঞ্চায়েতে বিরোধীদের প্রায় কোনও অস্তিত্বই নেই। বিরোধীদের নিশানা করে নাটুর দাবি, ‘‘ওদের তো লক্ষ্যই ছিল না মনোনয়ন জমা দেওয়ার। মানুষের জমায়েত করে ১৪ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে আসার পরিকল্পনার পিছনে ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল গন্ডগোল পাকানো আর অশান্তি করা। সেটাই ঘটেছে ওই দিন। ব্লক থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এই ঘটনা কারা ঘটিয়েছে তা আমাদের জানা নেই। আমরা ব্যস্ত ছিলাম ব্লক অফিসে। বরং এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১৭ জন নিরীহ মানুষ এখনও জেলে।’’ তবে মনসুরের মৃত্যু ‘বেদনাদায়ক’ বলে জানিয়েছেন নাটু। তবে পাশাপাশিই তাঁর দাবি, ‘‘চোপড়ার পরিস্থিতি ভালই। এখানে এখন কোনও অশান্তি নেই।’’
চোপড়ায় ভোট নেই। কিন্তু মনসুর আছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy