—ফাইল চিত্র
এ বার পুজোয় দেশের পর্যটন মানচিত্র থেকে কার্যত বাদই হয়ে গেল কাশ্মীর।
শহরের পর্যটন আয়োজক সংস্থাগুলি প্রায় এক বাক্যে জানাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে উপত্যকা শান্ত হবে এমন আশা করা যাচ্ছে না। জুলাইয়ের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে অশান্তি। দিনকে দিন বেড়েই চলেছে গুলি-কার্ফু-হরতাল-মৃত্যুমিছিল। এই অবস্থায় আগামী এক মাসে পরিস্থিতির বদল হোক বা না হোক, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনও রকম ঝুঁকি তারা নেবেন না।
দোলাচল অবশ্য ছিলই। তবে তার মধ্যে ছিল আশার আলোও। পর্যটনের স্বার্থে আর রাজ্য জুড়ে বাণিজ্যের স্বার্থে কি একটুও নামবে রাজনৈতিক অস্থিরতার পারদ? উত্তরটা না, বলছে উপত্যকা নিজেই। এক তরুণ কাশ্মীরবাসীর কথায়, ‘‘পর্যটকেরা দু’দিনের জন্য এসে, হেসে, ছবি তুলে চলে যান। সমস্যার সঙ্গে সারা
বছর ঘর করতে হয় তো আমাদের। গুলি খেতে হয় আমাদের। তাই লড়াইটাও আমাদের। সেটা চলবেই। আপস করব না।’’
সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন পর্যটকেরাও। তাই দ্বিতীয় বার না ভেবেই বাতিল করছেন কাশ্মীর ভ্রমণের যাবতীয় পরিকল্পনা। সুভাষগ্রামের বাসিন্দা বিশ্বকল্যাণ চৌধুরী জানালেন, তাঁরা ১৮ জনের একটি দল এ বছর পুজোয় কাশ্মীর যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। প্লেন, হোটেল, গাড়ি— সব বুকিংই করা হয়ে গিয়েছিল। ‘‘কিন্তু ভরসা করতে পারছি না।’’— বললেন বিশ্বকল্যাণবাবু। জানালেন, বুকিং ক্যানসেল করতে চড়া খেসারতও দিতে হয়েছে।
সমস্যা স্বীকার করে নিচ্ছেন বৌবাজারের একটি পর্যটন আয়োজক সংস্থার কর্ণধার রক্তিম রায়। জানালেন, তাঁদের সংস্থার তরফে এ বছর প্রায় ৪০০ জনের বুকিং ছিল কাশ্মীর যাওয়ার জন্য। সবটাই বাতিল হয়েছে। অনেকটা টাকা নষ্ট। যাঁরা বুকিং করেছিলেন, তাঁদের হিমাচল, কিন্নর, রাজস্থান যাওয়ার বিকল্প দিচ্ছে এই সংস্থা। গড়িয়াহাটের একটি পর্যটন সংস্থার তরফে অমিত দে বললেন, ‘‘মানুষ দু’টো দিন আনন্দ করতে বাইরে যান। কিন্তু এখন কাশ্মীরের যা পরিস্থিতি, তাতে প্রতিটি পদক্ষেপে মাসুল গুণতে হবে তাঁদের। এক টাকার জিনিস পাঁচ টাকায় কিনতে হবে বাধ্য হয়ে। আমরা তো বাজেটেই কুলোতে পারব না।’’ তিনি জানালেন, এ বছর প্রথম থেকেই বুকিং নেওয়ার সময় কাশ্মীরকে একটু এড়িয়ে চলছিলেন তাঁরা। কারণ আগেও একাধিক বার তাঁদের ক্ষতির মুখ দেখিয়েছে কাশ্মীর।
এ কথা অবশ্য পূর্ব অভিজ্ঞতার জেরে আগেই বুঝে গিয়েছিল শহরের অন্যতম বড় এক ভ্রমণ আয়োজক সংস্থা। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত সংস্থাটির মুখপাত্র আশিস বিশ্বাস সাফ বললেন, ‘‘শুধু পুজো নয়, এই বছরেই কাশ্মীর ভ্রমণের কোনও আয়োজন করিনি।’’ পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি নিতে রাজি নন তাঁরা। জানালেন, গত বছর কাশ্মীর ভ্রমণ আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু বন্ধ-হরতাল-কার্ফুতে বিধ্বস্ত কাশ্মীরে ঘোরার আনন্দের চেয়ে বিপদের আশঙ্কাতেই বেশি ভুগেছেন পর্যটকেরা। এখন তো পরিস্থিতি আরও খারাপ। তাই তাঁদের ভ্রমণের তালিকা থেকে এ বছর একেবারেই বাদ পড়েছে ভূস্বর্গ।
রেলের বাণিজ্যিক শাখার তরফেও খবর, পুজোর বুকিং হুজুগে এ বছর প্রথম থেকেই পিছিয়ে কাশ্মীর। উত্তরবঙ্গে, উত্তর-পূর্ব ভারতে আর দিল্লির দিকে বেশি মুখ ঘুরিয়েছেন মানুষ। শেষ মুহূর্তে এসে পুরীর টিকিটও কাটছেন অনেকে। ‘ট্র্যাভেল এজেন্টস ফেডারেশন ইন্ডিয়া’-র পূর্বাঞ্চলীয় শাখার চেয়ারম্যান অনিল পঞ্জাবিও জানালেন, কাশ্মীরের প্রায় সমস্ত বুকিংই শেষ মুহূর্তে এসে বাতিল হচ্ছে। এতে সব পক্ষেরই ক্ষতি হচ্ছে। গোয়া, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরবঙ্গে চাপ বাড়ছে। প্লেনের টিকিট, হোটেল— সব কিছু নিয়েই আতান্তরে পড়ছে পর্যটন সংস্থাগুলো। দিশাহারা পর্যটকেরাও।
বিবাদী বাগ এলাকার আর একটি পর্যটন সংস্থার কাছে কাশ্মীর ভ্রমণের প্যাকেজ বুক করছিল ১৪ জনের একটি দল। সংস্থার মালিক দিব্যেন্দুকুমার সাহা জানালেন, তারা সকলেই এখন নৈনিতালমুখী। তড়িঘড়ি সে ব্যবস্থাই করতে হয়েছে সংস্থাকে। তার ক্ষোভ, ‘‘মানুষ আগে নিজের ভাল বোঝে। কাশ্মীর ব্যতিক্রম। রাজনীতির জটিলতায় মার খাচ্ছে উপত্যকার অর্থনীতি। মার খাচ্ছে ছোট বড় অসংখ্যা ব্যবসা। ক’দিন পরে পেটে টান পড়লে তাঁরা বুঝবেন পর্যটন ব্যবসাকে মার খাইয়ে ভাল থাকবেন না উপত্যকার মানুষ।’’
সব মিলিয়ে সত্যিই ভাল নেই উপত্যকা। অন্ধকার শিকারায়, সুনসান আপেল বাগানে, কার্ফুরুদ্ধ হোটেলে, সারি সারি সেনা বুট ঠুকে যাওয়া রাস্তায়— মোটেই ভাল নেই তাঁরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল মালিক জানালেন, ব্যবসা বলে আর কিছু নেই। এই সময়টায় অসংখ্য নতুন হাসিমুখকে স্বাগত জানাতে হিমশিম খাওয়ার কথা ছিল। দিনভর উজ্জ্বল রোদ্দুর মেখে শিকারায় করে ঘোরানোর কথা ছিল অতিথিদের। তার বদলে সারা দিন শুধু বুকিং বাতিলের ফোন ধরতে হচ্ছে। ‘‘কী বলব ম্যাডাম, কেউ না আসাই ভাল। এই অশান্তির আবহে ভাল থাকবেন না অতিথিরা। সে তো আমাদেরই লজ্জা।’’ — চাপা রইল না ফোনের ও-পারের দীর্ঘশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy