Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
West Bengal Panchayat Election 2023

রক্তাক্তই রইল নির্বাচন, নিহতের সংখ্যা অন্তত ১৪, ভোট কেমন হল? উত্তর মিলল না রাজীব সিংহের

শনিবার পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে দেখা গেল, বহু জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার পাওয়া মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

West Bengal Panchayat Election 2023

বহু অশান্তির সাক্ষী হয়ে রইল পঞ্চায়েত নির্বাচন। ছবি: পিটিআই।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ২২:০৪
Share: Save:

হিংসা, খুনোখুনির ঘটনা ঘটল দিনভর। বাংলার ভোটের ‘রীতি’ মেনেই বিরোধীদের তরফে উঠল বুথদখল, ছাপ্পা, ভোটারদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ। এমনকি, ভোটের আগেই ‘ভোট’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগও। তার মধ্যেই শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যে ৬৬.২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। যে ভোট দেখল ১৪ জনের মৃত্যু আর অন্তত ২৫ জনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা। যে ভোটের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতরে তালা ঝোলালেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

ভোট পণ্ডিতদের একাংশ অনুমান করেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদলের ‘দখলদারি’ হবে একপেশে। কিন্তু শনিবার পঞ্চায়েত ভোটের ময়দানে দেখা গেল, বহু জায়গায় পাল্টা মার খেয়ে পিছু হটেছে শাসক তৃণমূল। বস্তুত, পঞ্চায়েত ভোটে শনিবার পাওয়া মৃত্যুর খতিয়ানে তৃণমূলই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তা ছাড়া, রাজ্যের অন্তত দু’টি এলাকায় তৃণমূলের লোককে ল্যাম্প পোস্টে বেঁধে প্রকাশ্যে পেটানো হয়েছে। যা সাম্প্রতিক অতীতে অভাবনীয়!

কর্মী খুনের ঘটনাকে সামনে রেখে তৃণমূল অবশ্য বলার চেষ্টা করছে, তাদের লোকদের ‘টার্গেট’ করে করে খুন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তারা ‘ভিক্টিম কার্ড’ হাতে নিয়ে নেমেছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের এই প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে যে, শাসকদল হিসেবে তারা নিজেদের লোকদেরও নিরাপত্তা দিতে পারছে না কেন!

সামগ্রিক ভাবে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের ঘোষণার পর থেকে এখনও পর্যন্ত রাজনৈতিক হিংসার বলি ৩৫। শনিবার নিহত ১৪ জনের মধ্যে মুর্শিদাবাদে চার, কোচবিহার, মালদহে তিন এবং দিনাজপুরে দু’জন এবং নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এক জন করে রয়েছেন। এখনও বাকি, আগামী ১১ তারিখের গণনা। ফলে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘতর হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে পুরোমাত্রায়। যুযুধান রাজনৈতিক পক্ষের পাশাপাশি হামলার শিকার হয়েছেন ভোটকর্মীরাও। গণতন্ত্রের সৈনিক হওয়ার ‘লড়াইয়ে’ তাঁদের অনেকেই আহত। রাজ্য নির্বাচন কমিশন শনিবার ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ ভোটকর্মীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

তবে বাংলায় এমন ঘটনা নজিরবিহীন নয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের তথ্য এবং ইতিহাস বলছে, ২০০৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ৭৬ জন (তার মধ্যে শুধু মুর্শিদাবাদেই ৪৫ জন)। ২০০৮ সালে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৬। দু’টি ভোটই হয়েছিল বামফ্রন্টের রাজত্বে। তৃণমূল জমানায় ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের হিংসার বলি হয়েছিলেন ৩৯ জন এবং ২০১৮ সালে ২৯ জন। তার মধ্যে ভোটের দিনেই ১৩ জন। অর্থাৎ মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে নতুন কোনও ‘নজির’ তৈরি করেনি এ বারের পঞ্চায়েত ভোট।

‘অপারেশন সূর্যোদয় ২.০’

বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটের চিত্র দেখে শনিবার এমনটাই বলছেন বিরোধী শিবিরের অনেকে। বুথদখল, ছাপ্পা, বোমা বা গুলির মতো ‘পরিচিত ছবির’ পাশাপাশি এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকের নতুন কৌশল দেখেছে বাংলা। অভিযোগ, ভোটদান শুরু হওয়ার আগেই ‘ভোট’ হয়ে গিয়েছিল বুথে বুথে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের আগেই। গভীর রাতে গিয়েই বিভিন্ন বুথের প্রিসাইডিং অফিসার এবং ভোটকর্মীদের ‘বাগে এনেছে’ শাসকদলের বিশেষ বাহিনী। যাঁদের বড় অংশ ছিল ‘বহিরাগত’। কতকটা ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের মতোই।

West Bengal Panchayat Election 2023

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

‘অনুপস্থিত’ কেন্দ্রীয় বাহিনী

মনোনয়ন পর্ব থেকেই রাজ্যে হিংসার অভিযোগ উঠেছে। রাজ্যের সব ভোটকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে বিরোধীরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাই কোর্টের। হাই কোর্ট ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর নির্দেশ দেয়। জানায়, সব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য রাখতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজ্যের সব ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যেরা। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, ৬০ হাজার বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত এক চতুর্থাংশে তারা রয়েছে। কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ বুথেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি বলেন অভিযোগ।

শাসকের সাফাই

পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। শনিবার বিকেলেই সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, ‘‘বিরোধীরা কুৎসা, বিভ্রান্তি অপপ্রচার, করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন চায়নি কেউ। ১৩-১৪টি জেলাতে নির্বিঘ্নে ভোট হয়েছে। ৮-৯টি বুথে ‘মেজর’ (বড়) ঝামেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬০টি। ৬১৫৩৯টি বুথ। অর্থাৎ, ০.০০০৯ শতাংশ।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ ছিল। তাঁরাও প্রভাব খাটিয়ে ভোট করিয়েছে। আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মৃত্যুগুলির মধ্যে ৬০ শতাংশ তৃণমূলের কর্মী।’’ দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘বিরোধীরা আতঙ্কের মার্কেটিং করছেন। বিপণন চলছে। যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ তৃণমূলের। ২৭ জনের মধ্যে ১৭ জন আমাদের দলের।’’

হার মানলেন অধীর

বিভিন্ন জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস ছিল, এ বার মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ দখলে তৃণমূলকে কড়া টক্কর দেবে কংগ্রেস। ‘প্রথা’ মেনেই এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের দিন সেখানেই মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক— চার জন। কিন্তু লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ভোটের পরে ‘আগাম জয়ের শুভেচ্ছা’ জানালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলা জুড়ে রক্তাক্ত নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে অধীরের মন্তব্য, ‘‘অভিনন্দন দিদি, আপনি জিতে গিয়েছেন।’’

কমিশনে তালা শুভেন্দুর

ভোটে অশান্তি এবং প্রাণহানির ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য নির্বাচন কমিশন দফতরের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ভোট ‘লুট’ করতে সাহায্য করেছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ। তিনি দাবি করেন ভোটে হিংসায় নিহতদের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা করে দিতে হবে। আহতদের দিতে হবে ১০ লক্ষ টাকা। পাশাপাশি, ভোটপ্রক্রিয়া নিয়ে এনআইএ তদন্তের দাবি করেন বিরোধী দলনেতা। আর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি করেছেন।

বস্তুত, শনির সকালেই পঞ্চায়েত ভোটে ‘রাক্ষসতন্ত্রের’ উদ্‌যাপন চলছে বলে আক্রমণ করেছিলেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রামে নিজে ভোট দেওয়ার পর কালীঘাট যাওয়ার ডাক দেন। বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘গুলি করুক, চলো কালীঘাট, ইটগুলো খুলে নিয়ে আসি।’’ পাশাপাশি বাংলায় ৩৫৬ অথবা ৩৫৫ জারি করারও দাবি করেন শুভেন্দু। বলেন, ‘‘বাংলাকে বাঁচাতে, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে, যা করতে হয় করব। এখানে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে হলে ৩৫৬ অথবা নির্বাচনের সময় ৩৫৫ করে যদি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে ইমপার্শিয়াল বা নিউট্রাল না করেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে কোনও ভোট হতে পারে না।’’ অন্য দিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি পঞ্চায়েত ভোটে শাসকের সন্ত্রাস নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে।

ছাপ্পা মারল সিপিএম!

পঞ্চায়েত ভোটে ব্যালট পেপারে ছাপ্পা মারা হচ্ছে সিপিএম প্রার্থীর পক্ষে! শনিবার এমন দৃশ্যই ধরা পড়ল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটের বাদুড়িয়া ব্লকের আঠুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি বুথে। ছাপ্পা ভোট পড়তে দেখা গেল ‘কাস্তে হাতুড়ি’-তে। ব্যালট পেপারে সিপিএমের প্রতীকে একের পর এক ছাপ্পা দিতে দেখা গেল দুই যুবককে। এই ঘটনার একটি ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE