পোঙ্গো পিগমেউস-বোর্নিওর ওরাংওটাং এবং পোঙ্গো আবেলি-সুমাত্রার ওরাংওটাং
আলিপুর চিড়িয়াখানায় তাদের শেষ দেখা গিয়েছিল প্রায় দেড়শো বছর আগে। চিড়িয়াখানায় তারা বরাবরই দুর্লভ। কিন্তু আর বছর কুড়ি পরে আদি বাসস্থানটিতেও তাদের দেখা মিলবে কি না সন্দেহ! জীববিজ্ঞানীরা তাই এখন থেকেই চিন্তায় পড়েছেন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ (আইইউসিএন) প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে ‘ওয়র্ল্ড কনজারভেশন কংগ্রেস’ আয়োজন করেছিল। সেখানেই ওরাংওটাংদের ‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুমাত্রা ও বোর্নিওর জঙ্গলই ওরাংওটাংদের আদি ভূমি। সেখানেও তাদের সংখ্যা গত দু’দশক ধরে কমছে। সংরক্ষণের তকমাও লেগেছে গায়ে। কিন্তু তাতেও খুব লাভ হয়নি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন বন্যপ্রাণ গবেষণা সংস্থার হিসেবে, বর্তমানে গোটা বিশ্বে ওরাংওটাংদের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। ওরাংওটাংরা বিলুপ্ত হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাস্তুতন্ত্রের যেমন ক্ষতি হবে, তেমনই হারিয়ে যাবে বিবর্তনের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
অতঃপর? পৃথিবী জুড়ে এখন যে সব চিড়িয়াখানায় ওরাংওটাং আছে, তাদের বাঁচিয়েবর্তে রাখার জন্য শুরু হয়েছে বাড়তি তৎপরতা।
আলিপুর চিড়িয়াখানায় ওরাংওটাংয়ের স্মৃতি কোনও কর্মীরই নেই। অতীতের নথি ঘেঁটে বর্তমান অধিকর্তা আশিস সামন্ত জানালেন, ১৮৭৬ সালে ব্রিটেন থেকে ‘জেনি’ নামে একটি মাদী ওরাংওটাংকে নিয়ে আসা হয়েছিল। বছরখানেক পরে তাঁর এক পুরুষসঙ্গীও আসে। কিন্তু সে বেশি দিন বাঁচেনি। ১৮৭৮ সালে জেনিকে ব্রিটেনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় রয়্যাল সোসাইটি। কেন্দ্রীয় জু অথরিটি সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক কালে এ দেশে কানপুর এবং ওড়িশার নন্দনকানন চিড়িয়াখানায় ওরাংওটাং দেখা যেত। কানপুরের ওরাংওটাং মঙ্গলের জন্ম হয়েছিল এ দেশেই। তার বাবা-মাকে ব্রিস্টল থেকে এনেছিলেন চিড়িয়াখানা কর্তারা। চলতি বছরের ৫ মার্চ ৩৬ বছর বয়সে মারা গিয়েছে সে। সুতরাং আপাতত এ দেশে ওরাংওটাং-এর ঠিকানা বলতে শুধু নন্দনকানন। কিন্তু সে-ও অতিবৃদ্ধ। তার উপরে নিঃসঙ্গও বটে! নন্দনকাননের অধিকর্তা শিশিরকুমার আচার্যের আক্ষেপ, ‘‘দেশবিদেশ ঢুঁড়েও মাদী ওরাংওটাং খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে নন্দনকাননেও ওরাংওটাংয়ের বংশরক্ষা সম্ভব নয়।’’
ওরাংওটাং এমনিতেই দুর্লভ। ফলে বিদেশের চিড়িয়াখানায় থেকেও কেউই সহজে ওরাংওটাং দিতে রাজি হয় না। তার উপরে অতিমাত্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ার পরে চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপে এদের প্রজনন ঘটানো (ক্যাপটিভ ব্রিডিং) এখন আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সে দিক থেকেও কেউ আর ওরাংওটাং হাতছাড়া করতে রাজি হচ্ছে না বলেই জানাচ্ছেন এ দেশের চিড়িয়াখানা-কর্তারা।
•পোশাকি নাম: ওরাংওটাং
•মালয় ভাষায় যার অর্থ: ‘অরণ্যের মানুষ’
•বিজ্ঞানসম্মত নাম: পোঙ্গো পিগমেউস -বোর্নিওর ওরাংওটাং, পোঙ্গো আবেলি -সুমাত্রার ওরাংওটাং
•আয়ুষ্কাল: ৩৫-৪৫ বছর। মেয়ের গর্ভকাল ৯ মাস। ১৪-১৫ বছর থেকেই সন্তানের জন্ম দিতে পারে।
•গায়ের রং: চামড়া কালচে ধূসর। উপরে লালচে বাদামি রোম।
•খাবার: ফল, কচি পাতা, পাখির ডিম, পোকামাকড়।
•বসবাস: পূর্ণবয়স্ক পুরুষেরা একা থাকে। মেয়েরা সন্তানসন্ততি নিয়ে বসবাস করে। খুদেরা কখনও কখনও
দল বেঁধে বসবাস করে।
•ডাকাডাকি: মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিশেষ ডাক। রেগে গেলে আবার দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে। জিভ ও ঠোঁট একসঙ্গে করে অন্যদের বিকট আওয়াজ করে ভেংচিও কাটে এরা।
জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, ওরাংওটাংয়ের সঙ্গে মানুষের জিনের গঠন প্রায় ৯৭ শতাংশ মেলে। এর বুদ্ধিমত্তাও মানুষের অনেক কাছাকাছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম সাহার কথায়, ‘‘এই প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হলে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের একটি ধাপও কিন্তু হারিয়ে যাবে।’’ কেন বিপন্ন হয়ে পড়ল তারা? বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাম তেল চাষের জন্য সুমাত্রা ও বোর্নিওর জঙ্গল হু হু করে সাফ হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে ২৬ লক্ষ হেক্টর অরণ্য কমে গিয়েছে সেখানে। জঙ্গল কমে যাওয়ায় খাবার ও বাসস্থানের অভাবে পড়ছে এরা। কখনও কখনও জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় খাবারের জন্য হামলা করছে। সেখানেও পূর্বপুরুষদের রেয়াত করছে না মানুষজন। তার উপরে চোরাশিকারি ও পাচারকারীদের উৎপাত তো রয়েইছে। ফলে গত ১০ বছরে ওরাংওটাংদের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার কমে গিয়েছে।
ওরাংওটাংরা হারিয়ে গেলে প্রভাব পড়বে সুমাত্রা ও বোর্নিওর বাস্তুতন্ত্রে। ক্ষতি হবে গাছেদের সাম্রাজ্যেও। কারণ, জঙ্গলের গাছের ফলই শুধু খায় না এরা, সেই ফলের বীজ জঙ্গলের নানা জায়গায় ছড়ায়। সেই বীজ থেকেই আবার নতুন গাছ জন্ম নেয়। ‘‘এই কাজের জন্যই ওরাংওটাংদের অরণ্যের মালি বলে,’’ মন্তব্য জীববিজ্ঞানের এক গবেষকের। তাঁর মতে, ওরাংওটাং যে ভাবে বুদ্ধি করে বীজ ছড়ায় তার তুলনা মেলা ভার!
এই বিপদের মধ্যে ওরাংওটাংদের বাঁচানো কী ভাবে সম্ভব? কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের অধীনস্থ ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার বিজ্ঞানী এস সত্য কুমার বলছেন, প্রথমেই অরণ্য ধ্বংস ও চোরাশিকার বন্ধ করতে হবে।
পাশাপাশি ওরাংওটাংদের ঘেরাটোপে রেখে প্রজনন ঘটাতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার পার্থের চিড়িয়াখানায় ওরাংওটাংদের বংশবৃদ্ধির প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। আমেরিকা-সহ আরও কিছু দেশে এই প্রকল্প চলছে। এর বাইরে আইইউসিএন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড-সহ বেশ কয়েকটি সংস্থা ইতিমধ্যেই ওরাংওটাংদের বাঁচাতে নেমেছে। নেট দুনিয়াতেও চলছে সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা।
পূর্বপুরুষকে বাঁচাতে উত্তরসূরির এই লড়াই সফল হবে কি না, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy