গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরজি কর-আন্দোলন কি শুধু শহরে এবং মফস্সলেই রয়েছে? তা কি গ্রামের আলপথ ছোঁয়নি? কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন এলাকার শহুরে তৃণমূল নেতৃত্ব এখনও এটা ভেবেই কিছুটা নিশ্চিন্তে যে, আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে ‘নাগরিক আন্দোলন’ এখনও পর্যন্ত নগর এবং মফস্সলেই ‘সীমাবদ্ধ’। তা এখনও সে ভাবে গ্রামে পৌঁছয়নি। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের তৃণমূল নেতৃত্ব অন্য কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, গত পাঁচ-সাত দিনে পরিস্থিতি পাল্টেছে। গ্রামে গ্রামে মিছিল হচ্ছে। এবং তার কলেবর ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যাশিত ভাবেই জেলাপরিষদ স্তরের নেতা বা গ্রামাঞ্চলের বিধায়কেরা তাঁদের নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক। তবে তাঁরা গ্রামের আন্দোলনের মধ্যে নানা ব্যাখ্যাও খুঁজে পাচ্ছেন।
কলকাতার তৃণমূল নেতাদের একটা অংশ অবশ্য অস্বীকার করছেন না যে, গ্রামে এই আন্দোলন একেবারে পৌঁছয়নি। তবে তাঁদের যুক্তি, অনেকাংশেই সেই আন্দোলন ‘হুজুগে’ পড়ে হচ্ছে। সেই অর্থে সরকার বা তৃণমূল বিরোধিতার কারণে নয়। তাঁরা জানলে সম্ভবত বিস্মিতই হবেন যে, গ্রামাঞ্চলের নেতাদের অনেকেই তাঁদের সঙ্গে একমত নন।
গত ১৪ অগস্ট রাতে ‘মেয়েদের রাত দখল’ কর্মসূচি রাজ্যে অভূতপূর্ব ছবি তৈরি করেছিল। যদিও সেই আন্দোলনের ৯০ শতাংশই ছিল শহর, জেলাসদর এবং মফস্সল শহর এলাকায়। কিন্তু এখন শহরের সঙ্গে গ্রামের স্বরেও ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ জুড়ে যাচ্ছে। মিছিলে না হলেও আগে-পরে সরকার বিরোধিতার স্বর শোনা যাচ্ছে। তবে তা ‘দীর্ঘমেয়াদি’ হবে না বলেও আশা তৃণমূলের গ্রামীণ নেতাদের একাংশের।
পশ্চিম মেদিনীপুরের এক তৃণমূল বিধায়ক শনিবার বলছিলেন, ‘‘পাঁচ ছ’দিন আগেও এই জেলার গ্রামাঞ্চলে মিছিলের এই হিড়িক ছিল না। হঠাৎ করেই সেটা কিছুটা বেড়েছে।’’ তবে তাঁর এ-ও বক্তব্য যে, ‘‘আমি যা জানতে পেরেছি, যে সব ছবি পেয়েছি, সবেতে বিচারের দাবিই ধ্বনিত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়া বা ওই ধরনের কোনও রাজনৈতিক স্লোগান উঠেছে বলে শুনিনি।’’ আরামবাগ শহরের এক তৃণমূল নেতা তাঁর শ্বশুরবাড়ির গ্রামের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘সিপিএমের ভরা জমানায় ওরা ভয় দেখিয়ে মিছিলে লোক নিয়ে যেত। সেই জমায়েতকেও ছাপিয়ে গিয়েছে গ্রামের মহিলাদের মিছিল।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমার ছোট শ্যালিকা আর তার ১৯ বছরের মেয়েও মিছিলে গিয়েছিল।’’ পূর্ব বর্ধমানের জেলা পরিষদের এক কর্মাধ্যক্ষের বক্তব্য, ‘‘স্কুলের প্রাক্তনীদের নামে অনেক জায়গায় মিছিল হচ্ছে। যা গত এক সপ্তাহে সংখ্যায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’’
উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহের জেলা তৃণমূলের নেতারাও মেনে নিচ্ছেন, এখন আর বিষয়টি শুধু শহর এবং মফস্সলের গণ্ডিতে আটকে নেই। তা ক্রমশ ছড়াচ্ছে। মালদহের এক তৃণমূল নেত্রী বলেন, ‘‘হাওড়ার একটি স্কুলের দিদিমণির বক্তব্য সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। যেখানে তিনি বার্তা দিয়েছেন, ১৮ বছর না হলেও নিজের মত প্রকাশ করা যায়। তার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায় স্কুলের প্রাক্তনীরা রাস্তায় নামছেন। সেই মিছিলে শামিল হচ্ছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারাও।’’
এর কারণ কী? এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা রয়েছে তৃণমূলের নেতাদের। কারও বক্তব্য, এর পিছনে রয়েছে সমাজমাধ্যমের প্রচার। আবার কারও বক্তব্য, সিপিএম এবং বিজেপি স্থানীয় স্তরে মিলেমিশে ‘অরাজনৈতিক’ মোড়কে এই সব কর্মসূচি গ্রহণ করছে। পূর্ব বর্ধমানের এক নেতার দাবি, ‘‘বিজেপির মধ্যে সিপিএম লোক ঢুকিয়ে রেখেছে। যে সংগঠিত কায়দায় কর্মসূচিগুলো হচ্ছে, তাতে বামেদের সাংগঠনিক ধাঁচ স্পষ্ট।’’
তা হলে শহুরে তৃণমূল নেতাদের বড় অংশ এত নিশ্চিন্তে কেন?
সে বিষয়ে গ্রামাঞ্চলের প্রায় সব নেতার বক্তব্যই এক। তাঁরা বলছেন, শহরের নেতারা মূলত সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যম দেখে ভাবছেন গ্রামে ‘তেমন কিছু’ হচ্ছে না। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের এক বিধায়ক বলেন, ‘‘জাকাত মাঝি পরগনা যে ভাবে কয়েক দিন আগে ধামসা-মাদল নিয়ে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে নেমেছিল, রাস্তা অবরোধ করেছিল, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই ধরনের সংগঠনগুলো সচরাচর নিজেদের দাবি ছাড়া রাস্তায় নামে না। কিন্তু তারাও পথে নামছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে যে, আরজি করের আঁচ তাদের কাছেও পৌঁছেছে। ফলে বিষয়টা হেলাফেলা করার নয়।’’ হাওড়ার আমতার তৃণমূলের এক প্রবীণ নেতার বক্তব্য, ‘‘যে সময় থেকে গ্রামাঞ্চলে মিছিল বাড়তে শুরু করেছে, সেই সময় থেকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আরও বেশি করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মিছিলে হয়তো সে ভাবে রাজনৈতিক স্লোগান উঠছে না। কিন্তু মিছিলের আগে-পরের জমায়েতে ফিসফাস থেমে নেই।’’
শহুরে তৃণমূল নেতারা এখনও ‘হুজুগ’ ভেবে নিশ্চিন্ত। গ্রামাঞ্চলের নেতারা নন। তাঁরা দেখছেন এবং মানছেন, আরজি কর আন্দোলন শহরের রাজপথ ছাড়িয়ে পৌঁছেছে গ্রামের আলপথেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy