জঙ্গলমহল থেকেই প্রতিরোধের ডাক দিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। মঙ্গলবার ঝিলিমিলিতে। — নিজস্ব চিত্র।
গত বিধানসভা ভোটে মুখ ফিরিয়েছিল কার্যত গোটা জঙ্গলমহল। আরও এক বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলকে রুখতে জঙ্গলমহল থেকেই প্রতিরোধের ডাক দিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
মঙ্গলবার বিকেলে বাঁকুড়ার বারিকুল থানার ঝিলিমিলিতে এক জনসভায় দলের কর্মী-সমর্থকদের হাতে লাঠি, ডান্ডা নিয়ে তৃণমূলের ‘গুন্ডামি’র প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। দীর্ঘদিন পরে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার সীমানা ঘেঁষা বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে সিপিএম এই সভা করল। প্রাদেশিক কৃষকসভার উদ্যোগে এ দিন ঝিলিমিলি হাইস্কুল মাঠে ‘জঙ্গলমহল কনভেনশন’ নামে ওই সভার আয়োজন করা হয়েছিল। দুপুর দু’টোয় সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভিড় নেই দেখে তা শুরু হয় ঘণ্টা খানেক পরে। দুপুর তিনটে নাগাদ মঞ্চে আসেন সূর্যবাবু। মাঠ তখনও ফাঁকা। যা দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছিল জেলা সিপিএম নেতৃত্বের। ধীরে ধীরে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ভিড় বাড়ে। দিনের শেষে হাজার পাঁচেক মানুষের ভিড় দেখেই খুশি সিপিএম নেতারা।
‘জঙ্গলমহল হাসছে, পাহাড় হাসছে’ বলে যে দাবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করছেন, তা স্রেফ মিথ্যা দাবি করে সূর্যবাবু বলেন, “বিধাননগর, আসানসোল, হাওড়া কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিলাম। জঙ্গলমহলে, পাহাড়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার তা দেয়নি। পাহাড়, জঙ্গলমহল য়খন হাসছে, তখন ওখান থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী তুলতে ভয় পাচ্ছেন কেন মুখ্যমন্ত্রী!’’ পাঁচ বছর আগে পর্যন্তও এই ঝিলিমিলি এলাকা ছিল মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল। ঝিলিমিলি থেকে মাত্র দু-তিন কিলোমিটার দূরেই বেলপাহাড়ি ও বান্দোয়ানের সীমানা। তিন জেলার সীমানাবর্তী এই অঞ্চলে ২০১১ সালের আগে পর্যন্ত প্রায় আধ ডজন সিপিএম নেতা-কর্মীকে খুন করেছে মাওবাদীরা। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সূর্যকান্তবাবু অভিযোগ করেন, তখন তৃণমূল-মাওবাদীরা এলাকায় অশান্তি সৃষ্টি করেছিল। কিষেণজিকে ডেকে নিয়ে এসে খুন করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক জন বিশ্বাসঘাতক ওঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল। ওই মাওবাদীরা সব তৃণমূলে ভিড়েছে। কিষেণজিকে যারা ধরিয়ে দিল, তারাই এখন সামনে পিছনে রক্ষী নিয়ে ঘুরছে! তৃণমূলের নেতাও হয়েছে!’’
বাঁকুড়ার এই অঞ্চলে মাওবাদীদের আনাগোনা আবার শুরু হয়েছে বলে গোয়েন্দা দফতরের কাছে খবর। সেকথা উল্লেখ করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বলেন, “মাওবাদীদের আদর্শ ঠিক নয়। খুনোখুনির রাজনীতি আমরা কোনও দিনই পছন্দ করি না। আমরাই মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছি।’’ এর পরেই তিনি প্রশ্ন তোলেন, তৃণমূলের শাসনে জঙ্গলমহলে প্রচুর উন্নয়ন হয়ে থাকলে একের পর এক সমবায় ও ল্যাম্পসের নির্বাচনে তারা হারছে কেন? তাঁর দাবি, আসলে আদিবাসী মানুষ তৃণমূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। জঙ্গলমহল থেকে তৃণমূলকে উৎখাত করার জন্য কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে সূর্যবাবুর নিদান, “ছোবল মারার আগেই অন্ধকারের জীবদের কোমর ভেঙে দিতে হয়। আপনারাও তৃণমূলের সন্ত্রাস, গুন্ডামির প্রতিবাদে লাঠি, ডান্ডা নিয়ে সবাই এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন।’’
তিন জেলার সীমানায় সভা। তাই বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, বারিকুল, রাইপুর, হিড়বাঁধ, খাতড়া, সিমলাপাল, সারেঙ্গার পাশাপাশি পুরুলিয়ার বান্দোয়ান, মানবাজার, বোরো এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি থেকেও গাড়িভর্তি লোক এসেছিল এ দিনের সভায়। ঝিলিমিলির এই সভা করতে না দেওয়ার জন্য শাসকদলের লোকেরা বিভিন্ন এলাকায় শাসানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন সূর্যবাবু। তিনি বলেন, “রানিবাঁধের আকখুটা মোড়ে এ দিন আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বেশ কিছু গাড়ি আটকে হুমকি দিয়েছিল তৃণমূল। দু’দিন ধরেই ওরা আমাদের এই সভায় লোকজনকে না আসার জন্য হুমকি, শাসানি দিয়েছে।’’ জেলা পুলিশের অবশ্য দাবি, জঙ্গলমহলের কোনও এলাকাতেই সিপিএমের সভায় আসা কোনও গাড়িকে আটক করা হয়নি।
বাঁকুড়ার সভাধিপতি তথা জেলা তৃণমূল নেতা অরূপ চক্রবর্তী সিপিএমের সভাকে কটাক্ষ করে বলেন, “আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় জঙ্গলমহলে শান্তি বিরাজ করছে বলেই এত দিন পরে ওই এলাকায় সিপিএম এমন নির্বিঘ্নে সভা করতে পারল। এটা মুখ্যমন্ত্রীর কৃতিত্ব। জঙ্গলমহলে এই শান্ত পরিবেশ সিপিএমের ৩৫ বছরের রাজত্বে ছিল না। ওদের সভায় এ দিন লোক হয়নি। সভা ফ্লপ। তাই মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন সিপিএম নেতারা।’’
জেলার এক সিপিএম নেতা জানালেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ঝিলিমিলি হাইস্কুলের এক অনুষ্ঠানে এই মাঠেই সভা করেছিলেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তার পর ছোটখাটো কয়েকটা সভা হলেও জঙ্গলমহলে এত বড় মাপের সভা করেনি সিপিএম। সেই অর্থে রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে এই প্রথম সিপিএমের জনসভা ঝিলিমিলিতে। তাই মাঠ পুরো না ভরলেও যা ভিড় হয়েছে, তাতেই খুশি সিপিএম নেতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy