স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলির কতৃপক্ষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠল বনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই নেতার নাম মহম্মদ আব্দুল বাতেন আলি। অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলির স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংখ্যালঘু দফতর জেলা স্তরে যে কমিটি (ডিএলআইটি) গঠন করেছে তিনি তাঁর সরকারি প্রতিনিধি। বনমন্ত্রী বিনয় কৃষ্ণ বর্মন এবং তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি তথা পূর্ত দফতরের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষের নাম করে টাকা তুলতেন বলে অভিযোগ। কিছু টাকা নবান্নেও পৌঁছে দিতে হয় বলেও বাতেনবাবু দাবি করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ পেয়েই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কোচবিহার জেলা প্রশাসন। সংখ্যালঘু দফতরের কোচবিহার জেলা আধিকারিক ঘটনার তদন্ত করছেন।
তবে আব্দুল বাতেন আলি ওই ঘটনার পিছনে চক্রান্ত রয়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “ওই টিমের বাকি দুইজন সদস্য সহকারি স্কুল পরিদর্শক চিন্ময় বর্মন, মজিবর রহমান নানা জায়গা থেকে টাকা তুলতেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন শিক্ষা সেলের নেতা পার্থপ্রতিম রায়। তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করাতেই তাঁকে শায়েস্তা করতে ওই চক্রান্ত কষা হয়েছে। তিনিও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।”
এই ঘটনায় বনমন্ত্রী এবং রবীন্দ্রনাথবাবু অস্বস্তিতে পড়েছেন। কোচবিহারের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) দেবযানী ভট্টাচার্য বলেন, “বাতেন আলির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তদন্তে যা উঠে আসবে তার ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।” সংখ্যালঘু দফতরের কোচবিহার জেলা আধিকারিক প্রদীপ্ত ভক্ত জানান, তদন্ত শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, “অভিযোগপত্রে বেশ কিছু মাদ্রাসার নাম দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে টাকা তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ। ওই মাদ্রাসাগুলির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। রিপোর্ট জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেব।”
বনমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন ওই ঘটনার তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, “বাতেন আলি বা অন্য যে কেউ যদি অসাধু কাজ করে থাকেন, তাঁর শাস্তি হওয়া দরকার।” রবীন্দ্রনাথবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, বাতেন আলির সঙ্গে তাঁর কোনও রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই। বাতেন আলি যে ওই টিমের সদস্য হয়েছেন সেটাও তিনি জানতেন না বলে দাবি রবীন্দ্রনাথবাবুর। তিনি বলেন, “ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
সংখ্যালঘু দফতর সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার অনুমোদনহীন মাদ্রাসাগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। কোচবিহার থেকে স্বীকৃতি চেয়ে কয়েকশো অনুমোদনহীন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু দফতরের কাছে আবেদনপত্র জমা দেয়। তার মধ্যে ১৪৫ টি মাদ্রাসার একটি তালিকা জেলায় পাঠায় সংখ্যালঘু দফতর। এর মধ্যে ১০০টি মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়ার কথা। সেগুলির পরিকাঠামো সহ সমস্ত কিছু খতিয়ে দেখার জন্য জেলা স্তরে টিম গঠন করা হয়। সেখানে জেলা স্কুল (মাধ্যমিক) পরিদর্শক ছাড়াও একজন মাদ্রাসা বোর্ডের প্রতিনিধি এবং আরেকজন মাদ্রাসা ডাইরেক্টরেটের প্রতিনিধি রাখা হয়। ওই দুই জন তৃণমূলের দুই নেতা মাদ্রাসা শিক্ষক তথা জেলা পরিষদের সদস্য মজিবর রহমান এবং কাওসার আলমকে রাখা হয়। ঘটনাচক্রে, কাওসার আলমের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ ওঠায় তাঁকে মাস তিনেক আগে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ডাইরেক্টেরেটের প্রতিনিধি করে মাথাভাঙা হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাতেনকে পাঠানো হয়। বাতেন আলিকে সবসময় তৃণমূলের জেলা নেতাদের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতে দেখা যেত। তিনি তৃণমূলের মাদ্রাসা শিক্ষক সংগঠনের নেতা বলে পরিচিত। বছর খানেক আগেই তাঁকে রবীন্দ্রনাথবাবুর গাড়িতে বসে ঘুরতে দেখা গিয়েছে বলে দলের অনেকে দাবি করেছেন।
বর্তমানে বনমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়েছে বলে দল সূত্রের দাবি। বহু জায়গায় মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা যায় তাঁকে। সেই সুবাদেই তাঁকে সরকারি প্রতিনিধি করা হয় বলে দাবি তৃণমূলের একাংশের। অভিযোগপত্রে তিনটি মাদ্রাসার নাম দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ১৩ লক্ষ টাকা বাতেন আলি তুলেছেন বলে অভিযোগ।
জেলা স্কুল পরিদর্শকের হয়ে ওই টিমে কাজ করছিলেন সহকারি স্কুল পরিদর্শক চিন্ময় রায়। বাতেন আলি দাবি করেছেন, চিন্ময়বাবু, মজিবরবাবু, প্রাক্তন প্রতিনিধি এবং কোচবিহার জেলা শিক্ষা সেলের আহ্বায়ক পার্থপ্রতিম রায় চক্রান্ত করে তাঁকে ফাঁসিয়েছেন। তিনি বলেন, “ওই টিমে যোগদানের পর আমি বুঝতে পারি, এখানে টাকার খেলা চলছে। তাঁরা আমাকে জোর ১৫ টি মাদ্রাসা অনুমোদনের জন্য চাপ দেন। তা নিয়ে প্রতিবাদ করি। তাতেই তাঁরা চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসিয়েছেন। আমি জেলাশাসক সহ সবার কাছে লিখিত ভাবে বিষয়টি জানাব। এর মধ্যে প্রশাসনের কয়েকটি স্তরে জানিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানাব।” চিন্ময়বাবু, মজিবরবাবু অবশ্য বাতেন আলির দাবিকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তাঁরা একযোগে বলেন, “অনেক দিন ধরে ওই টিমে কাজ করছি। কেউ কখনও অভিযোগ তোলেনি। এ জন্য ঘটনার তদন্ত আমরাও চাই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy