দার্জিলিঙের সভায় যাওয়ার পথে মুখ্যমন্ত্রী। রবিবার। ছবি:রবিন রাই।
বিমল গুরুঙ্গের খাসতালুকে ফের তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চেহারা দেখল দার্জিলিং পাহাড়। রবিবার দুপুরে দার্জিলিঙের ম্যাল চৌরাস্তার জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, “নির্ভয়ে ভোট দিন। আমি আপনাদের পাশে আছি।”
দার্জিলিং কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়ার সমর্থনে এ দিন ম্যালে জনসভা করেন মমতা। এই কেন্দ্রে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সমর্থন করেছে বিজেপি-র প্রার্থী সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে। তাই মোর্চার ক্ষমতার কেন্দ্র দার্জিলিঙে মমতার সভা নিয়ে উৎসাহ ছিল পাহাড়বাসীর। বৃষ্টির মধ্যেই এ দিন সভায় রীতিমতো ভিড় দেখে দৃশ্যতই সন্তুষ্ট মনে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে। এ দিন কার্শিয়াঙে জিএনএলএফ-এর সভাতেও ভাল ভিড় হয়েছিল। জিএনএলএফ-ও তৃণমূল প্রার্থীকে সমর্থন করেছে।
সাম্প্রতিক অতীতে ভাইচুংয়ের সভার দিন দার্জিলিঙের বাদামতাম এলাকায় দোকানপাট, বাজার বন্ধ ছিল। অভিযোগ, মোর্চার হুমকিতেই সে দিন ওই এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে এ দিন মঞ্চ থেকেই মোর্চাকে একরকম চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মমতা ঘোষণা করেন, “হিম্মত থাকলে, কেউ আমাকে আটকে দেখাক।” তৃণমূল নেত্রীর অভিযোগ, এত দিন পাহাড়ে ভোটের নামে রিগিং হয়েছে। এরপরেই তিনি পাহাড়বাসীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে আহ্বান জানান।
রবিবার বিকেলে শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কের সভাতেও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, “মনে রাখবেন, আমি ভাঙি কিন্তু মচকাই না। এর আগে তিস্তা জলচুক্তি করতে দিইনি। বাংলা ভাগ করতেও দেব না।” দু’টি সভাতেই রাজ্যসভার সাংসদ অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই মতে, পাহাড়ে মোর্চা নেতাদের উপর বিরক্ত মানুষজন যাতে ভোট দিতে ভয় না পান, সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ের সভায় বারবার ‘অভয়’ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একাধিক বার তিনি বলেছেন, “যে ভাবে গোর্খারা দেশের জন্য লড়ার সাহস দেখিয়েছেন, তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাই বলছি নিশ্চিন্তে ভোট দিন। ডরো মত!”
গত বছর ২৯ জানুয়ারি দার্জিলিঙের চৌরাস্তায় উত্তরবঙ্গ উৎসবের অনুষ্ঠানের সময়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে স্লোগান উঠলে নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ বলে তা থামাতে বাধ্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে মোর্চা-তৃণমূল দূরত্ব বাড়ে। কয়েক মাস আগে ফের কাছাকাছি হয়েছিল দু’দল। কিন্তু দার্জিলিং কেন্দ্রের প্রার্থী স্থির করা নিয়ে ফের তৃণমূল-মোর্চা দূরত্ব তৈরি হয়। দলীয় প্রার্থীর হয়ে পাহাড়ে প্রথম প্রচারসভায় গিয়ে এ দিন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের কড়া সমালোচনাও করেছেন মমতা। তাঁর দাবি, জিটিএ-র টাকা লুঠ হচ্ছে। উন্নয়নের টাকা যথেচ্ছ খরচ করা হচ্ছে বলেও সন্দেহ তাঁর। এমনকী, গুরুঙ্গের কাজকর্ম নিয়ে মোর্চার অন্দরে এবং পাহাড়ে যে ক্ষোভ রয়েছে, তাও কিছুটা উসকে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল নেত্রীর কথায়, “উনি নিজেদের ছেলেমেয়েদের বাইরে পড়তে পাঠান। আর পাহাড়ে দিনের পর দিন স্কুল, কলেজ, বিদ্যুৎ, জল বন্ধ করে রাখেন। অর্থাৎ এখানে সব বন্ধ থাকুক, আর নিজেদের ছেলে-মেয়েরা বাইরে গিয়ে ভাল থাকুক।” প্রসঙ্গত, পাহাড়ে টানা বন্ধ চলার সময়ে গুরুঙ্গের ছেলে কেন বাইরে পড়ছেন, তা নিয়ে পোস্টার পড়েছিল।
মোর্চার জোটসঙ্গী বিজেপিকে বিঁধে তাঁর দাবি, কিছু দিন আগে দার্জিলিঙের গত বারের সাংসদ যশোবন্ত সিংহ তাঁকে ফোন করে সমর্থন চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, “এ বার তো বিজেপি ওঁকে (যশোবন্ত) টিকিটও দেয়নি, নির্দল লড়ছেন। কাজ ফুরোলে ওরা সবাইকেই ছুড়ে ফেলে দেয়।”
এ দিন সকাল থেকেই পাহাড়ের আকাশ ছিল মেঘলা। দুপুর বারোটা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে কর্মী-সমর্থকরা দাঁড়িয়ে থাকায় পাহাড়ের তৃণমূল নেতারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী যখন বক্তৃতা শুরু করেন তখনও বৃষ্টি চলছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়,“এই বৃষ্টি মানে, পাহাড় শান্তির জন্য কাঁদছে। যাঁরা পাহাড়ের শান্তি নষ্ট করছেন, তাঁদের চাই না।”
দার্জিলিঙের সভায় লিম্বু, লেপচা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। পাহাড়ের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ, ‘গুরুঙ্গ’ সহ ১১টি সম্প্রদায়ের তফসিলি উপজাতি স্বীকৃতির জন্য তাঁর উদ্যোগের কথা সভা জানিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “পাহাড়ের জন্য কী করেছি, প্লিজ সেটা ভেবে দেখুন।” সভা শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য বৃষ্টি থেমে যায়। আকাশ পরিষ্কার হয়। তা দেখে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, “পাহাড়ের আকাশ এখন পরিষ্কার। এটা শুভ ব্যাপার। আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকুন।”
মুখ্যমন্ত্রীর সভা প্রসঙ্গে মোর্চা সভাপতি গুরুঙ্গের বক্তব্য, “গণতান্ত্রিক দেশে যে কেউ যেখানে ইচ্ছে সভা করতে পারে। তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) অনেকবার পাহাড়ে এসেছেন তা সত্যি। নানা ব্যাপারে ফিতেও কেটেছেন।” কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে গুরুঙ্গের অভিযোগ। তবে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। রোশনের দাবি, “পাহাড়ের বাসিন্দাদের কেউ ভোট দিতে ভয় দেখায়নি, তাঁদের কোনও ভয়ও নেই। এখানে কোনও রিগিং হয়নি, এ বারেও হবে না। আর জিটিএ-র তহবিলকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
বিকেল ৪টেয় শিলিগুড়ির সভায় গোড়া থেকেই বিজেপি-কংগ্রেসকে-সিপিএমকে একযোগে আক্রমণ করেন তৃণমূল নেত্রী। তাঁর বক্তব্য, “কংগ্রেস এবং বিজেপি মিলে তেলঙ্গানা গড়ল। এখানেও তাদের ওই পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু পাহাড়-সমতল ভাইবোনের মতো আছে ও থাকবে। বাংলাকে ভাঙতে দেব না।” শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ে হুটহাট বন্ধ, আন্দোলনের জেরে সমতলের ব্যবসায়ীদের যে কী পরিমাণ দুর্ভোগ ও ক্ষতির মুখে পড়তে হয়, সেই প্রসঙ্গ টেনে আনেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আর্জি, “পরিবহণ, পর্যটন শিল্পে পাহাড়ের উন্নয়ন হয়। কথায় কথায় বন্ধ করে শিল্প ধ্বংস করা যাবে না। এখানে (সমতলে) আমার চেনা পরিচিত অবাঙালি অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাঁদের বলব, দয়া করে ওদের ভোট দেবেন না। মনে রাখবেন, আপনার ব্যবসার ক্ষতি হলে ওদের কিছু যায় আসে না। আমরা পাশে থাকব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy