গোড়ায় টালবাহানা করলেও বিরোধী ২৪টি চা শ্রমিক সংগঠনের দাবি মেনেই শেষ পর্যন্ত ‘অসম মডেল’কে অনুসরণ করে রাজ্যের চা শিল্পের নতুন মজুরি চুক্তি করল সরকার। একই সঙ্গে আগামী দু’বছরের মধ্যে চা শিল্পে ন্যূনতম মজুরি চুক্তি কার্যকর করার ঘোষণাও করে দেওয়া হল।
শুক্রবার শিলিগুড়ির উত্তরকন্যায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলা ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পর রাতে সরকারের মজুরি চুক্তির ঘোষণা করা হয়েছে। শেষে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বিরোধী সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ সরকারের শুধু প্রশংসাই করল না, চা চুক্তি নিয়ে আজ, শনিবারের আন্দোলনের কর্মসূচিকে বিজয় মিছিলেও বদলে ফেলা হল।
সরকারি সূত্রের খবর, এ দিন ন্যূনতম মজুরি চুক্তি কার্যকরী হওয়া পর্যন্ত চা বাগিচা আইন মেনে আগামী তিন বছরের জন্য সাড়ে ৩৭ টাকা মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি করা হয়েছে। প্রথম বছর সাড়ে ১৭ টাকা এবং পরের দুই বছরের জন্য ১০ টাকা করে মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে তার আগে ন্যূনতম মজুরি যে সময়ই সরকারের গড়া কমিটি ঘোষণা করবে, তখনই তিন বছরের চুক্তি খারিজ হয়ে যাবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ রাজ্যে চা শিল্পের তিন বছরের মজুরি চুক্তি শেষ হয়। বর্তমানে পাহাড়ে শ্রমিকেরা ৯০ টাকা এবং তরাই ডুয়ার্সে ৯৫ টাকা করে মজুরি পাচ্ছিলেন। সর্বত্র মজুরি এক রাখতে পাহাড়ের জন্য এক দফায় ৫ টাকা বেশি বাড়ানো হয়েছে। ন’টি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পর এ দিন চুক্তি হল। গত এক বছরের বকেয়া টাকা তিনটি কিস্তিতে মিটিয়ে দেওয়া হবে বলেও মালিকপক্ষ রাজি হয়েছেন। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক বৈঠকের পর বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর জট খুলল। সবাই সহমত হয়েছেন। আমরা মজুরি বাড়িয়েছি। আবার ন্যূনতম মজুরি চুক্তি ঠিক করার জন্য কমিটিও গড়েছি। কমিটির সময়সামী দু’বছর হলেও তা তিন মাসেও হয়ে যেতে পারে। সবই শ্রমিকস্বার্থে করা হয়েছে।”
বাগান মালিকদের যৌথ সংগঠন কনসালটেটিভ কমিটি অব প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিসিপিএ) সেক্রেটারি জেনারেল মনোজিৎ দাশগুপ্ত বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে মজুরি চুক্তি ভালই হয়েছে। চাকরির শর্তের কিছু জিনিস রয়েছে যা পরে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে আলোচনা হবে। নূ্যনতম মজুরি কমিটির বৈঠকে আমাদের বক্তব্য সবই তুলে ধরব।” আগামী ১৬ মার্চ ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শিলিগুড়িতে প্রথম বৈঠক হবে।
এ দিনের বৈঠকে শ্রমমন্ত্রী ছাড়াও পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব উপস্থিত ছিলেন। তৃণমূলের তরফে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, দোলা সেনরাও এসেছিলেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মন্ত্রী সুব্রতবাবুই বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে জট খুলতে শ্রম দফতরকে সাহায্য করেছেন। তৃণমূলের ‘বিবাদমান গোষ্ঠী’ বলে পরিচিত দোলা সেন, শোভনদেববাবুদের সঙ্গে কথা বলে দলীয় অবস্থানও ঠিক করেছেন। সুব্রতবাবু বলেন, “আমি রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি। দীর্ঘদিন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। নিজের একটা ইচ্ছা ছিল আজকের ঐতিহাসিক দিনে হাজির থাকার। অসমেও এমনভাবে মজুরি বৃদ্ধি এবং নূ্যনতম মজুরি চুক্তি বিষয়টি ঠিক হয়েছে।”
গত বছর চা মজুরি চুক্তি শেষ হওয়ার পরেই রাজ্যের ২৪টি বিরোধী সংগঠন জোটবদ্ধ হয়ে যৌথমঞ্চ গড়ে আন্দোলনে নামে। শুধুমাত্র মজুরি বৃদ্ধিই নয়, রাজ্যের চা শিল্পে ন্যূনতম মজুরি চুক্তি লাগু করার দাবিও তোলা হয়। বন্ধ থেকে শুরু করে মিছিল, মিটিং, স্মারকলিপির জেরে চা শিল্পের রাজনীতি সরগরম হয়ে ওঠে। অষ্টম দফার ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সরকার নূ্যনতম মজুরির বিষয়টি মেনে নিয়েও সময়সীমা না দেওয়ায় তা ভেস্তে যায়। এরমধ্যে জানুয়ারিতে অসমে ন্যূনতম মজুরির জন্য কমিটি গড়ে ২ বছরের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়। এই বিষয়টিকে সামনে নিয়ে জোরদার আন্দোলনে নামে যৌথমঞ্চ। জনজাগরণ যাত্রা থেকে শুরু করে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সামনেই রাজ্যের পুরসভা নির্বাচন। আবার শিলিগুড়ির তরাই-এর বিস্তীর্ণ এলাকায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। তা ছাড়া সামনে বছরই রাজ্যের বিধানসভা ভোট। এই অবস্থায় পিছু হঠে আসে সরকার। সুব্রতবাবুর মত ‘পোড়খাওয়া’ মন্ত্রী তথা দীর্ঘদিনের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নেতাকে ময়দানে নামানো হয়। এমনকি, এদিনের বৈঠক চলাকালীন শ্রমমন্ত্রী আলাদা করে যৌথমঞ্চের সঙ্গে বসেও আলোচনা করে সমস্যা মেটান।
যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক জিয়াউর আলম বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই নির্দিষ্ট সময়সামীর মধ্যে নূ্যনতম মজুরি চুক্তির দাবি করে আসছিলাম। এদিন তার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। যে সমস্ত বিষয় নিয়ে আপত্তি ছিল তাও বাদ দেওয়া হয়েছে। শ্রমমন্ত্রী অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন।”
বৈঠকের শেষ পর্যায়ে অবশ্য আদিবাসী বিকাশ পরিষদের দুটি গোষ্ঠীর গোলমালে সভায় উত্তেজনা ছড়ায়। তেজকুমার টোপ্পোরা চুক্তিতে সই করলেও জন বার্লা গোষ্ঠীকে সই করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। নিরাপত্তারক্ষীদেরও ডাকা হয়। পরে অবশ্য সমস্যা মেটে। এর আগে নূ্যনতম মজুরি চুক্তির নির্ধারণের কমিটিতে (২৭ জন) যৌথমঞ্চের আরও দু’জন সদস্যের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও বৈঠক সরগরম হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy