একই জমিতে আলু ও ভুট্টা চাষ। নিজস্ব চিত্র।
একে তো সময় লাগত বেশি। তার উপরে খরচও হতো দুই দফায়। প্রাক বর্ষায় বেশি জল হলে তো শস্যদানা বাঁচানো মুশকিল। লোকসানে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকত না চাষিদের। এই ভাবেই শীতের মরসুম থেকে গোটা উত্তরবঙ্গের চাষিরা বছরে পর বছর পর পর আলু এবং ভুট্টা চাষে অভ্যস্ত ছিলেন। চাষিদের এই সমস্যা সমাধানে এবার এগিয়ে এসেছেন পেরুর আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। গত বছরের শেষ থেকে তাঁরা রাজ্য কৃষি দফতরের সঙ্গে যৌথভাবে চাষিদের একই সঙ্গে আলু ও ভুট্টা চাষের প্রশিক্ষণ দেন। তার পরেই এবারের মরসুমে দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি এবং ফাঁসিদেওয়ায় পরীক্ষামূলক ভাবে এবার ওই দুই ফসলের চাষ শুরু হয়েছে। গোটা উত্তরবঙ্গে সাত জেলায় প্রথম বার। এবার বিনা মূল্যে চাষিদের বীজ-সহ আনুষঙ্গিক সাহায্যও করা হয়েছে।
শিলিগুড়ি মহকুমার কৃষি দফতরের অন্যতম সহ কৃষি অধিকর্তা মেহফুজ আহমেদ বলেন, “আলু ও ভুট্টা, দু’টিই উত্তরবঙ্গের অত্যন্ত অর্থকরী ফসল। কিন্তু দু’টি ফসলকেই এক সঙ্গে চাষ করে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানো যায়, তা চাষিরা জানতেন না। পেরুর বিজ্ঞানীদের সাহায্যে এবার ওই দুই ফসলের চাষ একযোগে হচ্ছে।” সহ কৃষি অধিকর্তা জানান, শিলিগুড়ি মহকুমার দু’টি ব্লক মিলিয়ে প্রায় ১০ বিঘা জমিতে এবার পরীমূলক ভাবে চাষ হচ্ছে। আলু ওঠা শুরু করেছে। ভুট্টাও খুব ভাল হচ্ছে। আগামী মরসুমে অন্যান্য এলাকায় চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ ভাবেই ভুট্টা ও আলু চাষ হবে।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, মহকুমার খড়িবাড়ি এবং ফাঁসিদেওয়া ব্লক মিলিয়ে প্রায় ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু এবং ৩৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়। বছরের নভেম্বর মাস নাগাদ চাষিরা জমিতে আলু চাষ করেন। আর ভুট্টা চাষ হয় মূলত ডিসেম্বর থেকে মে মাস অবধি।
সাধারণত আলু উঠলেই ভুট্টা লাগান চাষিরা। জমি তৈরি, সার, সেচ, বীজ সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে খরচ হয় ১৪ হাজার টাকার মতো। সেখানে ভুট্টা চাষে লাগে ৬ হাজার টাকার মতো। আলুতে বিঘা প্রতি লাভ হয় ২৫-৩০ হাজার মতো। আর ভুট্টার ক্ষেত্রে তা ৮ হাজার টাকার মতো। সেখানে একযোগে দুটি চাষ হলে খরচ হয় সাড়ে ১৫ হাজার টাকার মতো। লাভ একই।
বছর দু’য়েক আগে পেরুর আলু গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা দেশের বিভিন্ন কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ শিবিরে এই যৌথ চাষের প্রযুক্তির কথা তুলে ধরেন। সেখানে রাজ্যে কৃষি দফতরের অফিসারেরাও ছিলেন। পরবর্তীতে শিলিগুড়ি মহকুমা খড়িবাড়ি-ফাঁসিদেওয়া কৃষি ব্লক থেকে তাঁদের কাছে লিখিত প্রস্তাব পাঠানো হয়। গত বছর আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞরা এলাকাতেও আসেন। তার পরেই পরীক্ষামূলকভাবে তিনটি ফার্মাস ক্লাবের ১০ বিঘা জমি চিহ্নিত করা হয়। মূলত ছোট ছোট চাষিদের এই চাষের আওতায় প্রথমবার আনা হয়েছে।
কৃষি দফতরের অফিসারেরা জানান, আলুর পর ভুট্টা লাগানো হলেও অনেক সময়ই বৃষ্টি পড়তেই চাষের ক্ষতি হয়ে যেত। নতুন পদ্ধতিতে তার সম্ভাবনা নেই। এপ্রিলের গোড়াতেই ফসল উঠে যাবে। ভুট্টার জন্য কেবলমাত্র বীজের খরচ হয়। ফসলে সারও কম লাগে। আর জমির সবই আলুর চাষের সময়ই তৈরি হয়ে যায়। আলু বীজ বসানোর ৩০ দিন পর ভুট্টা চাষ জমিতে শুরু হয়। আলুর খেতে ২৪ ইঞ্চি দূরত্বে গাছ থাকে। এই ফাঁকেই ভুট্টা চারা বসানো হয়। এক একটি চারার মধ্যে ৮ ইঞ্চি দূরত্ব রাখা হয়। চলতি মাসেই আন্তর্জাতিক ওই গবেষণা কেন্দ্রের দিল্লিতে থাকা এ দেশের বিজ্ঞানীদেরও শিলিগুড়িতে আসার কথা রয়েছে। তাঁরা জমিগুলি ঘুরে দেখে চাষিদের সঙ্গেও কথা বলবেন।
খড়িবাড়ির আনন্দ ভূষণ বর্মন বা চটহাটের মহম্মদ জাহিদের মতো চাষিদের কথায়, “এতদিন পরিশ্রম, খরচ সবই বেশি হত। নতুন পদ্ধতিতে লাভের পরিমাণ বাড়ছে। প্রায় একই সময়ে দু’টি ফসল মিলছে। এই ভাবে আরও নতুন নতুন ফসলের চাষ করা সম্ভব হলে আমরা উপকৃত হব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy