বিষক্রিয়া: করলার জল বিষিয়ে দিচ্ছে প্রাণীর দেহাংশ, প্লাস্টিক প্রভৃতি। ছবি: সন্দীপ পাল
হাওয়া থেকে এখনও পৌষ সংক্রান্তির পিঠে-পায়েসের গন্ধ যায়নি। মাঘের সকালের হাওয়ায় নদীর জলে বিলি কাটছে। ঝকঝকে রোদ জলে ঝিলমিল আঁকছে। একটা বক পা ফেলে ফেলে মাঝ নদীতে হেঁটে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে। মাছরাঙা একবার জলে ছোঁ মেরেই পাশের আমগাছের গোড়ায় মাটির ঢিপিতে গিয়ে বসল। নদীর জলে প্রায় নুইয়ে পড়া বাঁশগাছের ডাল থেকে একটা হলুদ রঙের বউকথা কও পাখি উড়ে গেল।
দৃশ্যপটে এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই. তবে, এতটুকুতেই দেড়শো বছর পেরিয়ে আসা জলপাইগুড়ি শহরের করলা নদীর ছবি শেষ হয়ে যায় না। ছবির মতো সকালেও নদীতে ভেসে ওঠে মরা মাছ। জল থেকে উঠে আসে বিষের গন্ধ। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সাম্প্রতিক পরীক্ষায় করলা নদীর জলে মাত্রাতিরিক্ত বিষের উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। সে রিপোর্ট দেখে মৎস্য দফতরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপাতত করলা নদীর জলে আর মাছ ছাড়া হবে না। কিন্তু যে মাছ, জলজ প্রাণী করলা নদীতে রয়েছে, যে পাখি প্রতিনিয়ত সে নদীর জলে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে বা ভেসে বেড়াচ্ছে, তাদের শরীরে প্রতিবার একটু একটু করে ঢুকছে মারণ বিষ।
এই বিষের নাম ফেকাল কলির্ফম। মূলত গবাদি পশুর দেহাংশ জমে জমে জলে এই বিষ ছড়িয়ে পড়ে। মাছ থেকে শুরু করে জলজ প্রাণী তো বটেই, বিষের মাত্রা বেশি হলে সেই জল পান করলে মানুষেরও মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। নানা প্রয়োজনে করলায় নামতে হয় অনেককেই। তাঁদের অনেকেরই হাতে-পায়ে চুলকানি হচ্ছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই চুলকানির কারণ ওই বিষ। নিয়মিত করলা নদীর জলে হাত-পা ছোঁয়ালে মারাত্মক চর্মরোগও হতে পারে।
কী ভাবে বিষিয়ে গেল নদী
যত দূষণ শহরেই। জলের নমুনা পরীক্ষা করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেখেছে, জলপাইগুড়ি শহরে ঢোকার আগে করলা নদীর জল অনেক সুস্থ এবং স্বচ্ছ। এই আক্ষেপ রয়েছে জলপাইগুড়ি পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসুরও। মোহনবাবু বলেন, “কত প্রচার হয়েছে, কত অভিযান হয়েছে এ নিয়ে। তারপরও এখনও শহরের দিনবাজার থেকে থার্মোকল, প্লাস্টিক নির্বিচারে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়! চিকিৎসার বর্জ্য উপুড় করে দেওয়া হয় নদীতে! কারও কোনও সচেতনতা নেই’ কী ভাবে কমবে দূষণ!” পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলির অবশ্য ক্ষোভ রয়েছে পুরসভা-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। মৃত গবাদি পশু-প্রাণীর দেহ নদীতে ফেলা হয়। বর্ষার সময় নদীতে স্রোত থাকলে দেহাংশ ভেসে চলে যায়। শীতের শুখা নদীতে সে উপায় নেই। ক’দিন আগেই দেখা গিয়েছে মাঝ নদীতে জল থেকে জেগে রয়েছে মৃত গরুর দেহাংশ। নদীতে জল এতই কম যে, কুকুরের দল মাঝনদীতে গিয়ে সেই দেহ টানছে। নদীতে দেহাংশ পড়ে থাকলেও সেগুলি সময়মতো সাফ করা হয় না বলেই অভিযোগ পরিবেশপ্রেমীদের। নদীতে আটকে থাকা দেহাংশ নানা রাসায়নিক বিক্রিয়া করে জলে মারণ বিষ ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ফেকাল কলিফর্ম বৃত্তান্ত
• পশু-প্রাণীর দেহাংশ পচে এবং মলমূত্র থেকে এই ব্যাক্টেরিয়া তৈরি হয়।
• যে জলে এই ব্যাক্টেরিয়া রয়েছে, তা পান করলে অথবা কোনও ভাবে পেটে গেলে ডায়েরিয়া, আন্ত্রিক, হেপাটাইটিসের মতো রোগ হতে পারে।
• এই ব্যাক্টেরিয়া জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যার জেরে মাছেদেরর মৃত্যু হতে পারে।
• জলের মধ্যে বিক্রিয়া করে ছোট ছোট জলজপ্রাণী মেরে ফেলে ফেকাল কলিফর্ম।
• ১০০ মিলিলিটার জলে ২৫০০ ইউনিট পর্যন্ত এই ব্যাক্টেরিয়া থাকতে পারে।
• গত ২০ নভেম্বর সংগ্রহ করা করলা নদীর জলের নমুনায় ১০০ মিলিলিটারে ৫ হাজার ইউনিট ফেকাল কলিফর্ম মিলেছে।
• এত পরিমাণ ব্যাক্টেরিয়া দেখেই বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্ত, বিষিয়ে গিয়েছে নদীর জল।
এক নজরে করলা
• উৎস: বৈকুণ্ঠপুর।
• মোহানা: জলপাইগুড়ি শহর ছাড়িয়ে তিস্তা নদীতে গিয়ে মিশেছে করলা।
• বয়ে যাওয়া পথ: প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
ধমনিতে অতীতের বিষ
এঁকেবেঁকে চলা জলপাইগুড়ির শহরের এই নদীর কাহিনিতে বিষ মিশেছিল আট বছর আগে। রাঘব বোয়াল থেকে ছোট পুঁটি, বাঘা আড় থেকে রূপালি রঙের রাশিরাশি বোরোলি মাছ ভেসে উঠেছিল নদীর জলে। দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে গাঁয়ে শ্যাওলা পড়ে যাওয়া মাছও মরে গিয়েছিল বিষের ছোবলে। প্রাথমিক তদন্তে প্রশাসন জানতে পারে, শহর লাগোয়া কোনও চা-বাগান এলাকা থেকে প্রচুর কীটনাশক মিশে গিয়েছিল নদীর জলে। নিষিদ্ধ কীটনাশক এন্ডোসালফান জলে মিশেই রাশি রাশি মাছের মৃত্যু হয়েছিল করলায়। সেই ঘটনা জানতে পেরে হস্তক্ষেপ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। করলা নদীকে বিষমুক্ত করতে রাজ্য সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছিল। জলপাইগুড়িতে দফায় দফায় বৈঠক হয়। তিস্তা নদী থেকে জল ছাড়া হয় করলা নদীতে। দমকলের ইঞ্জিন দিয়েও পড়শি তিস্তার থেকে জল টেনে ফেলা হয় করলায়। তারপর বহুদিন করলায় মাছের দেখা মেলেনি। দেখা যায়নি মাছ-শিকারি পাখিও।
উধাও পরিযায়ীর দল
এই কিছুদিন আগেও করলা নদীতে বালিহাঁসের দেখা মিলেছিল। নদীর জলে বালিহাঁসের দলকে সাঁতার কাটতে দেখে পরিবেশপ্রেমীরা কেউ কেউ ভেবেছিলেন, ফের সুদিন ফিরেছে। মাসখানেক ধরে বালিহাঁসের দলের দেখা নেই করলায়। নদীর যে অংশে বালিহাঁস ভেসে বেড়াত, সেখানে জমে রয়েছে প্লাস্টিক, থার্মোকলের টুকরো জঞ্জাল। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সদস্য ভাস্কর দাসের কথায়, “পরিযায়ী পাখির দল খুবই স্পর্শকাতর হয়। নিশ্চয়ই ওরা টের পেয়েছে যে, জলে বিষের মাত্রা বাড়ছে। নদীর জল বিষাক্ত হলে শুধু পরিযায়ী পাখি কেন, কোনও পাখিই সে জলে শিকার করতে যাবে না। এখনও যে কয়েকটি বক বা মাছরাঙা পাখি দেখা যায়, তাও একদিন হয়তো উধাও হয়ে যাবে!’’
বিষমুক্তির পথ
করলা নদী নিয়ে সমীক্ষা করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, “জলপাইগুড়ি আমার খুব প্রিয় শহর। এক সময়ে জলপাইগুড়ি শহরে নিয়মিত যেতাম। করলা নদীকে ছোট থেকেই চিনি। প্রচুর নস্টালজিয়া রয়েছে করলা নদী নিয়ে। সেই সুন্দর নদী কী ভাবে বিষিয়ে গেল, সেটাও জানি। আমি করলা নদী নিয়ে দূষণ পর্ষদের রিপোর্ট দেখেছি। রিপোর্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে, করলা নদীর জল এখন খুবই বিষাক্ত!” করলা নদীতে স্বাভাবিক স্রোত ফিরে না এলে এই বিষ থেকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। প্রথমত প্লাস্টিক থেকে শুরু করে যে কোনও আবর্জনা, বিশেষত মৃত প্রাণীর দেহাংশ— এ সব নদীর জলে ফেলা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই দুই বিষয়েই সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে। কমিটিও রয়েছে। কিন্তু কবে সেই কাজ শেষ হবে, তা জানা নেই কারও। বিষ নিয়ে আরও কতদিন এ ভাবেই মৃত্যুনদী হয়ে বয়ে যেতে হবে জলপাইগুড়ির করলাকে, সে উত্তরও নেই কারও কাছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy