সুস্বাদু: রসে ভেজে জিভে পড়ার জন্য তৈরি লালমোহন। নিজস্ব চিত্র
ভিটে জমির সঙ্গে ছেড়ে আসতে হয়েছিল মিষ্টির দোকানও। নতুন দেশে এসে মাথা গোঁজার জায়গা পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দোকান করতে পারেননি। ভাঁড়ে করে রসগোল্লা বেচতে শুরু করেন। শুধুমাত্র রসগোল্লা বেচে এলাকার প্রতিষ্ঠিত ময়রাদের ফাঁকে জায়গা করে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ঢাকা থেকে আসা ‘মণি ঘোষ’ও পারেননি। তাই ভাবনা শুরু হল অন্য সৃষ্টির। আর তার থেকেই উঠে এল ছানা এবং ক্ষীর মিশিয়ে রসে ভেজে তৈরি লাল বড়ো তুলতুলে মিষ্টি। চামচ দিয়ে তুলতে গেলেই তার শরীর ভেঙে ভুস ভুস করে রস বের হতে থাকে। জ্বিহ্বের ছোঁয়া মাত্র গলতে শুরু করে। অনেকে বললেন নরম পান্তুয়া। মণিবাবু ভালবেসে নাম রাখলেন ‘লালমোহন’। বাকিটা ইতিহাস। মণীন্দ্রনাথ ঘোষ বেঁচে নেই। রয়ে গিয়েছে তাঁর সৃষ্টি। ফুলবাড়ির লালমোহন।
দেশভাগের পরপরই ফুলবাড়িতে জন্ম হচ্ছে লালমোহনের। ঠিক তখন আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে বেলাকোবার বাসিন্দার মজে গিয়েছেন রস জ্বাল দেওয়ার কড়া গন্ধে। টাঙ্গাইল থেকে বেশ কিছু ছিন্নমূল মানুষ তখন এসে উঠেছেন বেলাকোবায়। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন পোড়াবাড়ির চমচমের কয়েক জন কারিগর। রেল লাইনের দু’পাশে বেড়ার দোকান গড়ে তাঁরা শুরু করেন চমচম তৈরি। পোড়াবাড়ির ঘরানায় কড়াপাকের চমচম হলেও এপারে এসে তার চরিত্রে ঘটল কিছু বদল। কড়াপাকে ক্ষীরের পরিমাণ গেল বেড়ে। চমচমের গোলাপি শরীরে বরফকুচির মতো ছড়িয়ে দেওয়া হল ক্ষীরের দানা। পেল্লায় সেই চমচমের নাম লোকমুখে হয়ে গেল বেলাকোবার চমচম।
ফুলবাড়ির লালমোহন এবং বেলাকোবার চমচম বিলেত পাড়ি দিয়েছে বহু দিন আগে। রসগোল্লার জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পরে আশায় বুক বেঁধেছে এই দুই মিষ্টি তৈরিতে জড়িতরাও। মিষ্টির স্বীকৃতি মিললে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে। বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিও হবে দুই জনপদের।
মণীন্দ্রনাথ ঘোষের পুরোনো দোকানটি এখনও রয়েছে। উল্টো দিকে ঘোষবাবুরই আরেক ছেলে বছর কয়েক হল নতুন দোকান করেছেন। দুই দোকানেই লালমোহনের রেসিপি এক। একটির কর্ণধার দীপকবাবু বললেন, ‘‘সকাল সাড়ে সাতটায় লালমোহন বানানো শুরু করি। শেষ হতে হতে চার ঘণ্টা লেগে যায়।’’ মূল দোকানটি চালান রতনবাবু। তাঁর ছেলে বিএড পড়ুয়া রূপম শিখে নিয়েছেন মিষ্টি বানানোর কৌশল। রূপমের কথায়, ‘‘কত গুণীজন এখানে খেয়ে গিয়েছেন। রসগোল্লা আমাদের পথ দেখাল। আমরাও এ বারে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করব।’’
‘এখানে বেলাকোবার চমচম পাওয়া যায়’ অথবা ‘ফুলবাড়ির লালমোহন পাওয়া যায়’— এমন পোস্টার শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি তো বটেই, উত্তরবঙ্গের অনেক মিষ্টির দোকানেই মেলে। কিছু জায়গায় স্থানীয় চমচমকেও ‘বেলাকোবার চমচম’ বলে চালানো হয় বলে অভিযোগ কালীদাস দত্তের নাতি লিটনের। বঙ্গের রসগোল্লা জয়ের খবর পেয়ে তিনি ইতিমধ্যে নেট ঘাঁটাঘাটি শুরু করেছেন। লিটনের কথায়, ‘‘জিআই স্বীকৃতি পেলে বিপণন আরও একধাপ এগোবে। জোরকদমে সেই কাজে লাগতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy