খাঁচায় ঝিলিক। নিজস্ব চিত্র
কেউ হাত না বাড়িয়ে দিলে একা একা চলাফেরার শক্তি নেই কিশোরীর। কাঠের খাঁচায় বন্দি অবস্থায় কাটে দিনের অনেকটা সময়। নেই কথা বলার ক্ষমতা। আছে বলতে দারিদ্র আর দুর্দশা। জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে একের পর এক সঙ্কট। তবু তার মধ্যেও আছে বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা। কোচবিহারের মাথাভাঙার বড়াইবাড়ির বর্মণ পরিবারের সদস্যরা চান, খুশির হাসি ঝিলিক দিয়ে যাক তাঁদের মেয়ের মুখে।
মাথাভাঙার আঙ্গারকাটা পারডুবি গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়াইবাড়ির বাসিন্দা শ্যামল বর্মণ এবং সুচিত্রার দুই সন্তান। ছেলে শিবু কলেজ পড়ুয়া। বছর ষোলোর মেয়ে ঝিলিক বিশেষ ভাবে সক্ষম। আর তাকে নিয়েই দুর্ভাবনায় পরিবারের সকলে। মেয়ের শরীরের প্রতিবন্ধকতার ছাপ জন্মগত। ঝিলিকের শৈশবের সেই ইতিহাস টেনে সুচিত্রা বলছেন, ‘‘৭-৮ মাস বয়সে সব শিশুই সাধারণত বসতে পারে। কিন্তু ও বসতে পারত না। তখন আমরা কোচবিহারে স্থানীয় চিকিৎসকদের দেখাই। তাঁরা চিকিৎসা করেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। আবার যখন হাঁটার সময় হল দেখলাম, ও হাঁটতে পারছে না। তখন লোকজনের পরামর্শ শুনে নিয়ে বেঙ্গালুরু যাই। আমাদের চাঁদা তুলে অর্থ জোগাড় করে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেখানে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করার কথা বলেন। তবে সুস্থ হবে কি না তা তাঁরা নিশ্চিত করে বলেননি। সেখান থেকে ফিরে আসি।’’
এর পর? আশঙ্কার মেঘ অহরহ উঁকি দেয় বর্মণ পরিবারের সদস্যদের মনে। বাবা দিনমজুর। সকাল হতেই বার হয়ে যান রোজগারের আশায়। বাড়িতে মা একা। বাড়ির কাজ সামলে সব সময় মেয়েকে দেখভাল করতে পারেন না তিনি। পরিবারের যা আর্থিক সঙ্গতি তাতে মেয়েকে দেখভালের লোক আলাদা করে রাখা অসম্ভব। তাই সেই সময়টা মেয়েকে আটকে রাখেন তিন ফুট বাই তিন ফুট একটা খাঁচার ভিতরে।
পাশে দাঁড়ায় না কেউ? প্রশ্ন শুনে একরাশ বিরক্তির সুরে সুচিত্রা বললেন, ‘‘পঞ্চায়েতে গেলেই বলা হয়, আপনারা যান। আমরা পরে খোঁজখবর করব। কিন্তু কেউ খোঁজ করে না। আমরা কত বার যাব? ওদের কানে কি আমাদের কথা পৌঁছয় না? আমার বাড়ির কাছেই তো প্রধানের বাড়ি। তা-ও যখন দেখতে পায় না, তখন আর কিছু বলি না।’’ সুচিত্রার দাবি, ‘‘মেয়েটাকে একটা গাড়ি দেওয়ার জন্য অথবা ভাতা দেওয়ার জন্য অনেক আবেদন করেছি। অনেক বার নানা নথিপত্র দিয়েছি। মেয়ের নামে অ্যাকাউন্ট করে ব্যাঙ্কেও খোঁজখবর নিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।’’
সংবাদমাধ্যমে কিশোরীর কথা জানতে পেরে বর্মণ পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন মাথাভাঙা ২ নম্বর ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক সুভাষচন্দ্র গায়েন। তাঁর দাবি, ‘‘এটা জন্মগত সমস্যা। মেয়েটির প্রতিবন্ধী শংসাপত্র আছে। করোনাকালে ছোটখাটো জায়গায় ওর চিকিৎসা সম্ভব নয়। আমাদের দফতর থেকে শংসাপত্র আগেই দেওয়া হয়েছে। ওঁরা কোথায় কোথায় সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন সেটা জেনে আমরা বিষয়টা দেখছি।’’
বর্মণ পরিবারের বাড়ি যে পঞ্চায়েত এলাকায় সেই আঙ্গারকাটা পারডুবি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অশোক বর্মণ দাবি করেছেন, ‘‘মেয়েটির চিকিৎসার জন্য স্থানীয় পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত প্রধান এবং গ্রামবাসীরা অর্থ সংগ্রহ করে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিল। বেঙ্গালুরুতে তার চিকিৎসাও হয়। আজ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক ওঁদের বাড়িয়ে বাড়িতে গিয়ে কথা বলেছেন। যাতে দ্রুত ভাতা চালু হয়। মেয়েটি যাতে সমস্ত সরকারি সুযোগসুবিধা পায় সে ব্যাপারেও তিনি পদক্ষেপ করবেন বলে ওই পরিবারটিকে আশ্বাস দিয়েছেন।’’ এ নিয়ে অবশ্য কিছু বলতে চাননি মাথাভাঙা ২ নম্বর ব্লকের বিডিও উজ্জ্বল সরকার।
দুর্দশা ঘিরে ধরেছে ষোলো বছরের জীবনটাকে। বর্মণ পরিবার চায় ক্লান্তির ছাপ বয়ে চলা মেয়ের মুখে ফুটে উঠুক হাসির ঝিলিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy