ছিটমহলে নানা জায়গায় আলু পড়ে রয়েছে জমিতেই। —নিজস্ব চিত্র।
পরিচয়পত্র নিয়ে কড়াকড়ির জেরে হিমঘরে আলু রাখার বন্ড সংগ্রহ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন ছিটমহলের চাষিরা।
বন্ড না পেলে অন্তত ১৫ মেট্রিক টন আলু খেতেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ বেড়েছে তাঁদের। শুক্রবার ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির তরফে ওই সমস্যার কথা দিনহাটার মহকুমা শাসক সহ কোচবিহারের পদস্থ প্রশাসনিক কর্তাদের জানান হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে ওই ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট আশ্বাস মেলেনি।
এই পরিস্থিতিতে চাষিদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে। দিনহাটার মহকুমা শাসক কৃষ্ণাভ ঘোষ অবশ্য বলেন, “বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। নির্দেশ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।” কোচবিহারের মুখ্য কৃষি আধিকারিক আশিস পাত্র বলেন, “জেলায় আলুর ফলন বেড়েছে। ফলে, হিমঘরে জায়গা কম হচ্ছে। ছিটমহলের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহার জেলা লাগোয়া বিভিন্ন ছিটমহলে ফি বছর গড়ে প্রায় দেড় হাজার একর এলাকায় আলু চাষ হয়। গত মরসুমে আলুর বাজার দর বেশি থাকায় এবারে ওই এলাকা বেড়েছে। ফলে সব মিলিয়ে অন্তত ৫০ মেট্রিক টন আলু উত্পাদন হয়েছে। কিন্তু দিনহাটা মহকুমা কিংবা লাগোয়া কোচবিহার সদর মহকুমার কোন হিমঘরেই সেখানকার চাষিরা আলু মজুত রাখার বন্ড পাননি এবার।
বন্ড সংগ্রহের জন্য কৃষক হিসাবে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের শংসাপত্র, কিষাণ ক্রেডিট কার্ড কিংবা সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র আবশ্যিক হয়েছে। তাই ছিটমহলের চাষিরা ওই সমস্যায় পড়েছেন। কারণ, সেখানকার বাসিন্দাদের কিষাণ ক্রেডিট কার্ড, সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র এমনিতেই নেই। গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফেও স্বাভাবিকভাবে শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে না। অথচ গত মরসুমেও সরাসরি জেলার বিভিন্ন হিমঘর থেকে বন্ড সংগ্রহ করেছিলেন ছিটমহলের বাসিন্দা বহু আলু চাষি।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “গত বছরের তুলনায় এবছর আলুর উত্পাদন কোচবিহার জেলায় প্রচুর বেশি হয়েছে। ফলে হিমঘরের বন্ড সংগ্রহে চাপ বেড়েছে। তার ওপর পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক হওয়ায় ছিটমহলের চাষিরা বন্ড সংগ্রহের আবেদন পর্যন্ত করতে পারছেন না। ফলে ছিটমহলে উত্পাদিত আলুর অন্তত ৩০ শতাংশ ধরলেও ১৫ মেট্রিক টন খেতেই নষ্ট হওয়ার মুখে। বিষয়টি কোচবিহারের প্রশাসনিক কর্তাদের জানানো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের হিমঘর মালিক সমিতির কর্তা মানিক বৈদ বলেন, “অন্যবার বন্ড সংগ্রহে এত বিপুল চাহিদা না থাকায় আগ্রহীরা সরাসরি তা সংগ্রহের সুযোগ পেতেন। এ বছর পুরোপুরি নিয়ম মেনে পরিচয়পত্র সংক্রান্ত বিষয় দেখেই বন্ড দেওয়া হচ্ছে।”
প্রশাসন ও কৃষি দফতর সূত্রেই জানান গিয়েছে, কোচবিহার জেলায় এ বার আলু উত্পাদনের এলাকায় সাড়ে ২৮ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ৩১ হাজার হেক্টর হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় বিঘা প্রতি আলুর উত্পাদনও গড়ে ১৫-২০ মণ বেড়েছে। এ বার সাড়ে ৯ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উত্পাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ অসম, ওড়িশা, ঝাড়খন্ডে আলুর তেমন চাহিদা নেই। তার ওপর জেলার ১২টি হিমঘরে বড় জোর দেড় লক্ষ মেট্রিক টন আলু মজুত রাখার পরিকাঠামো রয়েছে। প্রকৃত চাষিরা যাতে বন্ড সংগ্রহে সমস্যায় না পড়েন সেজন্য পরিচয়পত্র নিয়ে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। তার পরেও চাষিদের অনেকে বন্ড পাচ্ছেন না।
এই পরিস্থিতিতে ছিটমহলের চাষিদের সমস্যা নয়া সংযোজন। কৃষি বিপণন দফতরের এক জেলা আধিকারিকের কথায়, জেলার চাষিদের বন্ড নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বন্ড নিয়ে কালোবাজারির অভিযোগও উঠেছে। তাঁরা জানান, হিমঘরে জায়গা থাকায় আগে পরিচয়পত্র নিয়ে কড়াকড়ি হয়নি। দিনহাটা মহকুমা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাণা গোস্বামী বলেন, “আলুর ওপর দিনহাটার অন্য ব্যবসা অনেকটাই নির্ভরশীল। ছিটমহলের চাষিদের ক্ষতির কিছুটা প্রভাবও সেক্ষেত্রে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
মশালডাঙ্গা ছিটমহলের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন ২ একরে আলু চাষ করে ৩০০ কুইন্টাল ফলন পেয়েছেন। তিনি বলেন, “গতবার সহজেই বন্ড সংগ্রহ করে হিমঘরে আলু রাখার সুযোগ পেয়েছিলাম। এবার পরিচয়পত্র নিয়ে কড়াকড়ির জন্য সমস্ত আলু খেতেই ফেলে রেখেছি। এখন যা বাজার দর তাতে বিক্রি করলে চাষের অর্ধেক খরচ উঠবে না। কী করে কী হবে জানি না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy