রূপ: দুর্গা প্রতিমার চোখ আঁকতে মহিলা শিল্পী। বালুরঘাটের খিদিরপুর পাল পাড়ায়। ছবি: অমিত মোহান্ত
পুরাণের পাঁচ কন্যার মতো আধুনিক কন্যারাও বুঝিয়ে দিতে চান পাঁচ ইন্দ্রিয়ের শক্তিকে। আজ ঘ্রাণ
‘কিছু একটা পুড়ছে/ আড়ালে, বেরেতে, তোষকের তলায়, শ্মশানে.../ আমি ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি’
আর সেই আগুনের ছাইয়ে ঢেকে গিয়েছে চারপাশ। সাদা হয়ে গিয়েছে মাটি, আকাশ। পুড়েছে আমার মন, আমারই প্রিয়জন— ধোঁয়ায় সে দিন ভেসে ছিল তাঁদেরই গন্ধ। সেই গন্ধই ভেসে এসেছিল নদীর জলে, একের পর এক। তা-ই যেন মিশে ছিল হাসপাতালের শয্যা, ওষুধের কড়া গন্ধে। কেমন যেন সব একাকার হয়ে গিয়েছিল। ছিল শুধু দূর থেকে সাদা প্লাস্টিকে মোড়া আপনজনের দেহের ঘ্রাণ। স্মৃতিতে। শেষ দেখাটুকুও মেলেনি। চুল্লি থেকে শুধু ভেসে এসেছিল মায়ের হাতের সেই গন্ধ অথবা কোনও প্রিয়জন পাশে এসে বসলে যে সুবাস ছড়ায়, ঠিক তেমনটা!
পাক্কা দেড়টা বছর! বাতাসে মিশে তো সে সব গন্ধই। পোড়া মানুষ আর পোড়া মন!
মৃত্যুর ঘ্রাণ কিন্তু এখানেই শেষ নয়। অতিমারি পার হয়ে সে গন্ধে মিশে যায় বারুদ এবং তার ফলে তৈরি হওয়া ছাই-ও। সে-সব ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে বেড়িয়েছে ছোট্ট মেয়ে, কিছু যদি পাওয়া যায়! ততক্ষণে তার শৈশবের সমস্ত গন্ধ উধাও। নাকে শুধু আসে ছাই, বারুদ আর রক্ত। যে রক্ত গড়িয়েছে অনেক দূর। ক্রমশ হাওয়ায় মিশেছে, মিশছে তার গন্ধ। তা ছড়িয়ে পড়ছে এক মানুষ থেকে আর এক, কখনও বা মগজেও। কত দূর ছড়িয়ে পড়বে, ঠিক নেই কোনও।
তার পরেই ভিটে-মাটি-প্রাণ নিয়ে পালানোর কাতর আর্তি। ঘরেই তো পড়ে সব। শুধু মানটুকু বাঁচাতে সেই ঘরের আর মাটির শেষ গন্ধটুকু সঙ্গে নিয়ে প্রাণ হাতে করে বিমানের চাকায় চেপে বসা। তবে নিজভূমের সেই গন্ধ ছাড়েনি তাঁকে। মাঝ-আকাশ থেকে খসে মাটিতে পড়ে সেই ঘ্রাণই কি নিয়েছিল সে, শেষ বারের মতো! পথে-ঘাটে রক্তাক্ত পড়েছিল যারা, তারাও কি তা পেয়েছিল? নিজের ঘর-দোরের, রঙিন বা রংচটা দেওয়ালের, ইরানি কার্পেটের সুবাস ব্যাগবন্দি করে যাঁরা এসে উঠলেন পর-দেশে— ভাঙা হিন্দির পিছনে লুকিয়ে রইল তাঁদের পুশতু ভাষার গন্ধ। নতুন দেশে নতুন আঘ্রাণের সময় এখন, আগে তো প্রাণ!
আর যাঁরা পড়ে রইলেন? তাঁদের আশপাশে এখনও ‘কিছু একটা পুড়ছে/ প্রকাশ্যে, চোখের ওপর/ মানুষের মধ্যে/ স্বদেশ!’
পুড়ছে, হারাচ্ছে ক্রমে। দেশ, আমার মাটি, আমার ঘর। কোথাও তা গিয়ে শেষ হচ্ছে রক্তের গন্ধে, কোথাও নদীর পাড়-ভাঙা সোঁদা মাটিতে, কোথাও পুরনো আলমারির কোণায় ধুলোমাখা নথির গন্ধে।
এমনই তো নিজভূমি উদ্ধারে যুদ্ধ হয়েছিল সে দিন। অসুর-সৈন্য তখন পরাজিত। রক্তধারা বয়েছিল নদীর মতো। সে দিনও শুষ্ক হৃদয়ে প্রার্থনা ছিল, ‘বিঘ্ন দাও অপসারি’। তার পরেই ‘অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে/ সূর্য উঠে আসে/ বন্ধ থাকা ইশ্কুলের গায়ে ও মাথায়/ রোদ পড়ে’।
বার-বার রূপ বদলেও শেষে শূলে বিদ্ধ হয় মহিষাসুর। নিজ-মাটি ফিরে পেয়ে ফুল ছড়িয়েছিলেন দেবতারাও। সরেছিল অন্ধকার, রক্ত, হিংসা-দ্বেষ।
আমরাও বলেছিলাম, ‘‘মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।’’ তাই যুদ্ধক্ষেত্রের সেই রুদ্ররূপিণী আমাদের ঘরে এসেছিলেন মা হয়ে। রক্তে ভেজা তাঁর হাতে তখন শুধুই নরম আদরে মাখা শিউলির গন্ধ। আর আঁচলে ঠিক মায়ের মতো!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy