—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সবুজে গালচের মতো চা বাগানের মাঝে ছোট্ট একটি ফাঁকা জমিতে ত্রিপল বিছিয়ে বসেছেন শ্রমিকদের একাংশ। তাঁদের সামনে উপস্থিত কয়েক জন বিজেপি নেতা। নিজেদের ভাষণে বন্ধ চা বাগানের সমস্যা-সহ শ্রমিকদের পিএফ, গ্র্যাচুইটির মতো নানা বিষয় নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বুঝিয়ে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু তা চলাকালীনই ভিড়ের পিছনের সারিতে শুরু হল গুঞ্জন, “এরাই এ বারের পুজোয় চা বাগানে ১৯ শতাংশের বদলে ১৬ শতাংশ হারে বোনাসের চুক্তিতে সই করেছেন। তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোন মুখে বলছেন?” এ ছবি আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাটের। কাল বাদে পরশু (বুধবার) যেখানে উপনির্বাচন।
আপাত শান্ত বলে পরিচিত জেলা আলিপুরদুয়ার এখন রাজ্যবাসীর নজরে পর পর নাবালিকা ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায়। তাই ভোট-প্রচারে চা শ্রমিকদের সুবিধা-অসুবিধার পাশাপাশি আসছে নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ। বিজেপি নেতারা যা নিয়ে ক্রমাগত রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে বিঁধে চলেছেন। একই সঙ্গে বলছেন, ‘‘আলিপুরদুয়ার জেলা উত্তরবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে বড় শক্ত ঘাঁটি। তাই এই জেলাকে বদনাম করার চক্রান্ত করছে শাসক দল।’’ যা শুনে তৃণমূলের এক জেলা নেতা হেসে বলছেন, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ফলে, জেলায় পর পর এ ধরনের ঘটনা নিয়ে কোথায় আমরা বলব, ‘এটা বিরোধীদের চক্রান্ত’! ওঁরা উল্টে বলছেন।’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘মাদারিহাট উপনির্বাচনে ক্রমশ নিজেদের পিছিয়ে পড়া বুঝতে পেরে বিজেপি এমন বলছে।”
পরিসংখ্যানও বলছে, আলিপুরদুয়ারে বিজেপির ভোট ক্রমশ কমছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটে জেতে তারা। চলতি বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের ব্যবধান ছিল ৭৫,৪৪৭ ভোটের। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে মনোজ টিগ্গা ২৯,৬৮৫ ভোটে জেতেন। কিন্তু শেষ লোকসভা নির্বাচনে মাদারিহাট বিধানসভায় মনোজ এগিয়ে ছিলেন মাত্র ১১,০৬৯ ভোটে। ২০১৯-এর লোকসভায় জয়ী চা শ্রমিক নেতা জন বার্লা গত লোকসভায় বিজেপির টিকিট পাননি। বার্লা এবং মনোজের ‘সুসম্পর্কের’ কথা সুবিদিত। বার্লা এখনও ভোট-প্রচারে নামেননি। উল্টে, মাদারিহাটের তৃণমূল প্রার্থী জয়প্রকাশ টোপ্পোর প্রচারের সময় এক দিন বার্লাকে তাঁর সঙ্গে হাসি মুখে গল্প করতে দেখা গিয়েছে। বিজেপি প্রার্থীর হয়ে ভোট প্রচারে দেখা যাচ্ছে না এই এলাকায় চা শ্রমিকদের প্রভাবশালী সংগঠন ‘ভারতীয় টি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর বার্লা-ঘনিষ্ঠ নেতাদের অনেককে।
পাশাপাশি, এই উপ-নির্বাচনে প্রয়াত সিটু নেতা তারকেশ্বর লোহারের ছেলে রাহুল লোহারকে বিজেপি প্রার্থী করায় না-খুশ বিজেপি নেতাদের অনেকে। কেউ কেউ নির্দল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মনোজ টিগ্গাকে এলাকায় দেখা যায় না অভিযোগে মাকরাপাড়ায় ভোট-প্রচারে যাওয়া দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ রাজু বিস্তার সামনে কাঁদতে দেখা গিয়েছে বিজেপির এক কর্মীকে। মনোজ অবশ্য সবেতেই ‘তৃণমূলের চক্রান্ত’ দেখছেন।
তা হলে কি ‘অ্যাডভান্টেজ’ তৃণমূল? তৃণমূলের জমানায় চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি হয়েছে ২৫০ টাকা, ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ হয়েছে, মহিলা শ্রমিকদের শিশুসন্তানের ব্যবস্থাপনায় সরকারি ‘ক্রেশ’ রয়েছে মনে করিয়ে রাজ্যসভার সদস্য তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি প্রকাশ চিক বরাইকের দাবি, “এ বার ইতিহাস গড়ব।” তার পরেও অবশ্য প্রচারে বার বার ২০০৩ সালে বীরপাড়ার দলগাঁও চা বাগানে তারকেশ্বর লোহারের বাড়িতে হওয়া গণহত্যার প্রসঙ্গ টানতে শোনা যাচ্ছে তাঁদের। বিজেপি প্রার্থী রাহুল বলেন, “তৃণমূলের এই প্রচার নোংরা রাজনৈতিক চক্রান্ত।” তৃণমূল প্রার্থী বলেন, “মানুষ আরও জানতে চাইছেন। তখন তাদের সত্যটা বলছি।”
এটাও সত্য আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্যে মাদারিহাটই একমাত্র বিধানসভা, যেখানে আজ পর্যন্ত তৃণমূল জেতেনি। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের বছরেও এই আসনে জিতেছিল আরএসপি। তার পরের দুটি বিধানসভা ভোটে বিজেপি। সেখানে উপনির্বাচনের মুখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জলপাইগুড়ির সাঁকোয়াঝোড়া ১ এবং বিন্নাগুড়ি পঞ্চায়েত। মাদারিহাট বিধানসভার অন্তর্গত ওই দুই পঞ্চায়েতে ভোটদাতার সংখ্যা ষাট হাজারের কিছু বেশি। গত লোকসভায় এই দুই পঞ্চায়েতেই প্রায় ৭,৬০০ ভোটে পিছিয়ে ছিল রাজ্যের শাসক দল। সে কারণে জলপাইগুড়ির তৃণমূল নেতারা এখন ছুটছেন সেখানে। তা ছাড়া, প্রার্থী নিয়ে ক্ষোভের জেরে কিছু নেতাকে ভোট-প্রচারে গোড়ায় নিষ্ক্রিয় থাকতে দেখা গিয়েছিল। পরে পথে নামলেও, কতটা মন দিয়ে তাঁরা প্রচার করছেন, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে দলের অন্দরে।
মাদারিহাট উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেস ঐক্য হয়নি। সেখানে আরএসপির প্রার্থী পদম ওরাওঁ। কংগ্রেস প্রার্থী করেছে বিকাশ চম্প্রমারিকে, যিনি কালচিনির প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তথা বর্তমানে বিজেপি নেতা উইলসন চম্প্রমারির ‘তুতো’ ভাই। কংগ্রেসের জেলা নেতৃত্বের একাংশের আশা, উইলসনের ভাই হওয়ায় কিছুটা হলেও বেশি ভোট পাবেন বিকাশ। বিজেপির দিক থেকেই সে ভোট কাটা যাবে কি না, তা নিয়ে চলছে চর্চা।
বিজেপির ভোট-প্রচার থেকে ফেরার পথে এলাকার বন্ধ চা বাগানের কিছু শ্রমিককে বলতে শোনা গেল, “সেই কবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এসে কয়েকটি বাগান অধিগ্রহণের কথা বলেছিলেন। বার বার বিজেপি জিতলেও, তা পূরণ হল না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy