Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Mizoram bridge collapse

স্বপ্নপূরণে মিজ়োরামে পাড়ি, সেতু বিপর্যয়ে সব শেষ ঝাল্লুদের, ‘উজাড়’ হল মালদহের গোটা গ্রাম

ঝাল্লুরা ইংরেজবাজার ব্লকের বিনোদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নাগরপাড়ার বাসিন্দা। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

—ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
মালদহ শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ১৯:৫৮
Share: Save:

অনেক কষ্ট করে ভিটেতে কাঁচা বাড়ি দাঁড় করিয়েছিলেন বাবা। ছেলে ছোট থেকেই পাকা বাড়ি গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। ভিন‌্‌রাজ্যে ঘুরে ঘুরে শ্রমিকের কাজ করে যা কিছু রোজগার হত, তা দিয়ে ধীরে ধীরে পাকা বাড়ি তৈরিও করছিলেন। ঘাড়ে চাপে ঋণের বোঝাও। সংসারের অভাব দূর করতেই নিজের ছেলে, জামাই আর সদ্যযুবা নাতিকে নিয়ে মিজোরামের আইজলে পাড়ি দিয়েছিলেন মালদহের ঝাল্লু সরকার। বাড়তি রোজগারের আশায় সেতু তৈরির কাজে লেগেছিলেন তাঁরা। বুধবার সেই নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে প্রাণ গেল তাঁদের সকলের। এক ধাক্কায় পুরুষশূন্য হয়ে এখন অকূলপাথারে সেই ঝাল্লুর পরিবার।

ঝাল্লুরা ইংরেজবাজার ব্লকের বিনোদপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নাগরপাড়ার বাসিন্দা। তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তিন জনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী পুত্রবধূ এবং ছোট্ট নাতনিকে বাড়িতে রেখে আইজলে গিয়েছিলেন ঝাল্লু। ছেলে জয়ন্ত সরকার (২৬), জামাই রঞ্জিত সরকার (৪৬) এবং নাতি সুমন সরকার (১৯) ছাড়াও ঝাল্লুর সঙ্গে মিজোরামে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামেরই বাসিন্দা নব চৌধুরী। পরিবার সূত্রে খবর, বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ তাঁদের সকলের মৃত্যুর খবর বাড়িতে পৌঁছয়। ঝাল্লুর ভাই অনুপ সরকার বলেন, ‘‘অভাবের সংসার আমাদের। তাই ছেলে, জামাই আর নাতিকে নিয়ে মিজোরামে গিয়েছিলেন দাদা। ওরা আর ফিরবে না! বাড়িতে রোজগার করার মতো আর কেউ রইল না। পরিবারটাই ভেসে যাবে এ বার! কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।’’

খবর পেয়ে ঝাল্লুদের বাড়িতে যান ইংরেজবাজারের বিডিও সৌগত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। কী কী পদক্ষেপ করা যায় আমরা দেখছি। রিপোর্ট তৈরি করে জেলাশাসকের কাছে পাঠানো হবে।’’

ঝাল্লুদের সঙ্গে আইজলে গিয়েছিলেন নাগরপাড়ার প্রতাপ সরকারও। সেতু বিপর্যয়ে তাঁর অবশ্য কিছু হয়নি। প্রতাপ জানান, রোজকার মতো বুধবারও সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ তাবু ছেড়ে সেতুর কাজ করতে যান তাঁরা। তাবু থেকে ১০০ মিটার দূরে তৈরি হচ্ছিল সেতুটি। ৭০-৮০ ‌জন শ্রমিক কাজ করছিলেন সেখানে। এর পর সকাল ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ সেতুটি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। প্রতাপের কথায়, ‘‘চোখের সামনে সেতুটা ভেঙে পড়তে দেখেছি। মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটা যেন মৃত্যুনগরী হয়ে উঠেছিল!’’ প্রতাপ সেতুর যে প্রান্তে কাজ করছিলেন, তার ঠিক উল্টো প্রান্তে ছিলেন ঝাল্লু, জয়ন্তরা। প্রতাপ বলেন, ‘‘ব্রিজ থেকে ওদের পড়ে যেতে দেখলাম। মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। ওদের পরিবারকে কী জবাব দেব! আমরা সব সময় একসঙ্গেই থাকতাম। মনে হচ্ছে যেন, গোটা গ্রামটাই উজাড় হয়ে গেল।’’

নির্মীয়মাণ রেলসেতু ভেঙে অন্তত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে মিজোরামে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, তাঁদের মধ্যে ১১ জনই রতুয়া ২ ব্লকের চৌদুয়ার। এ ছাড়াও গাজল এবং কালিয়াচকের এক জন করে পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন মৃতদের তালিকায়। জেলাবাসীর দাবি, ভিন্‌রাজ্যে কাজে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু মালদহে নতুন ঘটনা নয়। কখনও বহুতল ভেঙে, কখনও নির্মীয়মাণ সেতু কিংবা পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। সম্প্রতি করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় জেলার একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তা-ও কেন ভিন্‌রাজ্যে ছুটছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা, সে প্রশ্নই ফের উঠেছে মিজোরামের ঘটনার পরে। মৃত পরিযায়ী শ্রমিক সেনাউল হকের (৪৮) স্ত্রী মিলি বিবি বলেন, “ভিন্‌রাজ্যে কাজে গিয়ে দুর্ঘটনায় বড় ছেলের কোমর ভেঙে যায়। সে কাজ করতে পারে না। তার দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। আমাদের তিন ছেলে-মেয়ে আছে।” ভিন্‌রাজ্যে কাজে না গেলে আটটা পেট চলবে কী ভাবে, প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, “নিজেদের কোনও জমি নেই। গ্রামে কাজও নেই। তাই ঝুঁকি নিয়ে কাজের জন্য স্বামীকে ভিন্‌রাজ্যে যেতে হয়েছে।”

ছেলে সাহিন আখতারকে (২০) হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা সাহেনা বিবি। তিনি বলেন, “উচ্চ মাধ্যমিকে ৪১০ নম্বর পেয়ে পাশ করে ছেলে মালদহ কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তিও হয়েছিল। তবে অভাবের জন্য পড়তে পারেনি। সংসারের হাল ফেরানোর জন্য বাবার সঙ্গে ভিন্‌রাজ্যে কাজ করত। সেই ছেলেরই দেহ দেখতে হবে, ভাবলেই শরীর যেন কাঁপছে।” মিজোরামে দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন চৌদুয়ারের বাসিন্দা রেফাজুদ্দিন শেখ। তিনি বলেন, “চাঁদে অভিযান নিয়ে অনেকে মাতামাতি করছে। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দু’বেলা রুটি-রুজির কথা কেউ ভাবছেন না।”

যদিও মালদহের জেলাশাসক নিতিন সিংহানিয়া বলেন, “প্লাস্টিক, কার্পেট ক্লাস্টার জেলায় তৈরি হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকেরা যাতে জেলায় কাজ করতে পারেন, সে জন্য ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া, রাজ্য সরকারের একাধিক প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের যুক্ত করার কাজও চলছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

bridge collapse Mizoram
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy