মঙ্গলবার রাতে শিলিগুড়ির হোটেল থেকে পর্যটকদের বার করে আনার পর। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
সিঁড়ি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া উঠে আসছে। আগুন লেগেছে। কিন্তু কোনও আপৎকালীন পথ নেই। তাই মঙ্গলবার রাতে শিলিগুড়ির প্রধাননগরের পটেল রোড বাইলেনের একটি হোটেলে আগুন লাগার পরে ওই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে গিয়েই মৃত্যু হয়েছে দেবরাজ কামি (২৮) এবং তারা এক্কা (২৫) নামে দু’জনের। হোটেলের মালিক মণিকুমার ছেত্রী বুধবার রাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন।
প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, রিসেপশনের পাশেই মেন সুইচ রয়েছে, সেখানে শর্ট সার্কিট থেকেই হোটেলের এক তলায় রাত ১টা নাগাদ আগুন লাগে। দ্রুত ছড়ায় আগুন। গ্রাস করে নেয় সিঁড়িও। তবে দমকল সঙ্গে সঙ্গেই আসে। দু’ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় সেখানে ২২ জন পর্যটক ও ৫ জন হোটেলকর্মী ছিলেন। পালানোর পথ না পেয়ে কেউ দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন, কেউ বা ছাদে উঠে যান। পাঁচ তলা হোটেলটির তিন তলায় ছিলেন দেবরাজ এবং তারা। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে তাঁরা আগুনের কবলে পড়েন।
হোসনাবাদ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক দেবরাজের বাড়ি লঙ্কাপাড়া চা বাগানে। রেলকর্মী তারা নিউল্যান্ড চা বাগান এলাকার বাসিন্দা। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, তারা কর্মসূত্রে তামিলনাড়ুর ভেলোরে থাকতেন। মঙ্গলবার সকালে তিনি শিলিগুড়ি আসেন। দেবরাজ একটি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফর্ম তুলতে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন। দুই পরিবার সূত্রেই জানানো হয়েছে, মঙ্গলবারই তাঁদের বীরপাড়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। যদিও দু’জনেই ওই দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ফোন করে রাতে ফিরতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। দু’জনেই অবিবাহিত। আগুনে হোটেলের আর কোনও পর্যটক আহত হননি। তবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সকলেই। কারও কারও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। দমকলকর্মীরা সেই রাতে আগুন নেভানোর পরে সিঁড়ি দিয়েই এক এক করে সকলকে নীচে নামান। সেই সময় তিন জন অল্পবিস্তর জখম হন।
পুলিশ ও দমকলের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গিয়েছে, হোটেলে আগুন নেভানোর যন্ত্র সাজানো থাকলেও তা কোনও কাজে লাগেনি। সেগুলির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, হোটেলের কর্মীরা কেউ সেগুলি ব্যবহার করতেও জানেন না। জল ঢালবার জন্য লম্বা পাইপও হোটেলে ছিল। কিন্তু আগুনেই তা পুড়ে গিয়েছে। হোটেলে কাঠের আসবাবপত্র বেশি বলে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে বলে দমকলের ধারণা। হোটেলটি প্রায় ২২ বছরের পুরনো। বিভিন্ন তলায় ছয়-সাতটি করে ঘর রয়েছে। ছাদেও ঘর করা হয়েছে। অথচ সিঁড়ি একটিই। আগুন সিঁড়িতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সে কারণেই দুই তরুণ তরুণী নামার চেষ্টা করতে গিয়ে বিপদে পড়েন।
হোটেল মালিক মণিকুমারবাবু বলেন, “এমন কিছু হবে কখনও ভাবিনি। বাড়িটি পুরনো। তবে দোতলার পিছনে একটি বেরোনোর দরজা ছিল। রিসেপশনে আগুন লেগে সব পুড়ে গিয়েছে।” তাঁর দাবি, হোটেলটির দমকল ও পুরসভার ছাড়পত্র রয়েছে। কিন্তু পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, গত দু’বছর ধরে ওই হোটেলটির ট্রেড লাইসেন্স নবীকরণ করা হয়নি।
দুর্গাপুজোর সময় শিলিগুড়ি পুলিশ, দমকল এবং হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষকে নিয়ে শহরে বৈঠক হয়। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জগমোহন বলেন, “হোটেল মালিকদের ডেকে অগ্নি নির্বাপণের ব্যাপারে তাঁদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এই ঘটনার পরে বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।” অথচ শহরের হিলকার্ট রোড, সেবক রোড, রাজা রামমোহন রায় রোড, ঋষি অরবিন্দ রোড এলাকার প্রচুর পুরনো হোটেল রয়েছে, যেগুলিতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ। প্রধাননগরের ঘটনার পরে নড়েচড়ে বসেছে পুরসভাও। পুর কমিশনার সোনম ওয়াংদি ভুটিয়া বলেন, “হোটেলগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শীঘ্রই আমরা কাজ শুরু করব। পুজোর আগেও কিছু কাজ করা হয়েছে। তবে এ বার কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বুধবার সকালে হোটেলে গিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের এনে তদন্ত শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy