Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ছেলেদের উৎপাতে টিউশনের ঠিকানাই বদলে নেয় মেয়ে

স্কুল শুরু হয় সকাল সকাল। ছুটিও হয় আলো পড়ার আগে। তাতেই মেয়েদের যাতায়াতের পথে রোমিওদের দৌরাত্ম্য সামলাতে হিমসিম অবস্থা পুলিশ-প্রশাসনের। কিন্তু যখন সন্ধে নেমে আসে? রাত গাড় হয়? মেয়েরে ফেরে টিউশন থেকে, তখন?

শান্তশ্রী মজুমদার
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:১৭
Share: Save:

স্কুল শুরু হয় সকাল সকাল। ছুটিও হয় আলো পড়ার আগে। তাতেই মেয়েদের যাতায়াতের পথে রোমিওদের দৌরাত্ম্য সামলাতে হিমসিম অবস্থা পুলিশ-প্রশাসনের। কিন্তু যখন সন্ধে নেমে আসে? রাত গাড় হয়? মেয়েরে ফেরে টিউশন থেকে, তখন?

কথা হচ্ছিল কাকদ্বীপের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁর মেয়ে পড়ে নবম শ্রেণিতে। প্রাইভেট টিউশন নিতে যেত মাইতির চক এলাকায়। মেয়ের বাবার কথায়, ‘‘সন্ধের পরে রাস্তায় পুলিশের নজরদারি সে রকম দেখিনি। রাস্তার উপরেই দাঁড়িয়ে মদ খায় ছেলেরা। অন্ধকার থাকে বেশিরভাগ সময়। মেয়ে পড়তে যেত একা একা। ভয় হতো। টোন-টিটকিরিও শুনতে হতো। বাড়িতে এসে সে সব বলত মেয়ে। একদিন ঠিক করলাম, ও দিকে আর মেয়েকে পড়তেই পাঠাব না। এখন অন্য জায়গায় যায় ও।’’

কয়েক মাস আগে কাকদ্বীপে যে মাধ্যমনিক পরীক্ষার্থী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটেছে, সেও পড়া থেকে সন্ধের পরে ফিরছিল বাড়ির দিকে। অন্ধকার রাস্তায় তাকে টেনে নিয়ে যায় ধর্ষক। নৃশংস অত্যাচারের পরে খুন করে। কানের দুল বেচে মদ খায়।

এই ঘটনায় স্মভিত হয়ে গিয়েছিল রাজ্যবাসী। তারপর থেকে চলেছে নানা রাজনৈতিক চাপানউতোর। পুলিশের নজরদারিও হয় তো কিছুটা বেড়েছে এলাকায়। কিন্তু সমস্যার সমাধান সে ভাবে হয়নি, মনে করেন কাকদ্বীপের বহু মানুষ। বিশেষত, যে বাবা-মায়ের মেয়েরা সন্ধের পরে পড়তে যায় এ দিক ও দিক। সব সময় যাদের বাবা-মা-দাদারা মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে পারেন না বা আনতে যেতে পারেন না প্রাইভেট টিউটরের বাড়ি থেকে বা কোচিং সেন্টার থেকে।

শুধু মহকুমা সদরই নয়, পাথরপ্রতিমা, সাগর, ফ্রেজারগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও একই পরিস্থিতি। ইভটিজিং, বেআইনি মদের দোকান, আলো না থাকার মতো সমস্যা রয়েছে বহু এলাকায়। অনেক সময়ে সমস্যার কথা থানা-পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছয় না। বরং মেয়েকে ওই পথ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয় বাড়ি থেকে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার চন্দ্রশেখর বর্ধন বলেন, ‘‘আমরা কেবলমাত্র স্কুল ছাত্রী কেন, সব মানুষকেই নিরাপত্তা দিই। সিভিক ভলান্টিয়ার ছাড়াও অফিসারেরা বিভিন্ন এলাকায় টহল দেন। তবে ছাত্রীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে এ রকম কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের কাছে নেই।’’

যাঁরা নিত্য সহ্য করেন এই সব উপদ্রব, তাঁদের সুর ভিন্ন।

কাকদ্বীপে স্কুল ছাত্রীর ধর্ষণের আগে পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট হরিপুর এলাকায় অনেক রাস্তায় রাতে আলো জ্বলত না। একই সমস্যার কথা উল্লেখ করলেন পাথরপ্রতিমার স্নাতকোত্তর প্রথমবর্ষের এক ছাত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘আমি পড়াই, নাচও শেখাই। ছাত্রীরা বাড়িতে আসে। আমাকেও সন্ধের পরে বেরোতে হয়। প্রতিনিয়ত আমাকে টিটকিরি সহ্য করতে হয় রাস্তার উটকো ছেলেদের কাছ থেকে।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘গোপালনগর, মাধবনগর, লক্ষ্মীনারায়ণপুরের মতো প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছাত্রীরা আসে পড়তে। ফেরার সময়ে অনেকেই একা যায়। রাস্তায় আলোটুকুও থাকে না ও সব দিকে।’’ সিভিক ভলান্টিয়ারদের টহলদারি থাকে পাথরপ্রতিমা বাজার এলাকায়। কিন্তু গ্রামের দিকেও নজরদারি চান স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা।

সাগর ব্লকের প্রধানকেন্দ্র থেকে একটু দূরে চেমাগুড়ি এলাকায় টিউশন পড়ান পার্থ দাস। তিনি জানালেন, গত বছর অক্টোবরে সাগরে পিকনিক ফেরত মদ্যপ যুবকের দল বাবার সঙ্গে থাকা এক স্কুল ছাত্রীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারপর থেকে সাগরের একটু প্রত্যন্ত এলাকায় সন্ধে ৭টার পরে টিউশন করা প্রায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে, একমাত্র নিরাপত্তা নেই বলেই। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘চেমাগুড়ি এলাকায় কয়েকটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। আমি তার একটিতে পড়াই। এ বছর থেকে বাণীজঙ্গল, গায়েন বাজার থেকে মেয়েদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অনেক বাবা-মা। তাই ওই এলাকাগুলি থেকে কোনও ছাত্রী নিতে পারনি আমরা।’’ তিননি জানালেন, পুলিশি টহলদারি কেবলমাত্র ছয়ের ঘেরি এলাকায় থাকে। কিন্তু ভিতরের রাস্তাগুলিতে সে সব চোখে পড়ে না।

নামখানার প্রত্যন্ত মৌসুনী দ্বীপেও রয়েছে একই সমস্যা। সাগরের এ সব এলাকায় কোচিং সেন্টারে পড়তে আসে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের ফেরার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। মৌসুনী দ্বীপের একটি জনপ্রিয় কোচিং সেন্টারের কর্তা শেখ আব্দুল হাসান বলেন, ‘‘কোচিং সেন্টারের বাইরে ইভ টিজারদের উৎপাত আছেই। তাই এলাকায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের টহলদারি আরও বাড়ানো দরকার। এখানেও সব এলাকায় আলো নেই। তাই রাত ৮ টার পরে আর মেয়েদের পড়ানো সম্ভব হয় না।’’ বামুনের মোড় থেকে লট ৮ যাওয়ার রাস্তায় এই সমস্যায় এর আগে সিভিক ভলান্টিয়ারদের মার খেতে হয়েছে, এই ঘটনাও ঘটেছে। পুলিশের এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমাদের হাতে যত সিভিক ভলান্টিয়ার রয়েছে, তা দিয়ে যতটা সম্ভব, তাই তো করতে পারব!’’ কলেজের পিছনের রাস্তা ছাড়াও, ছোট পোল থেকে কাকদ্বীপ বাজার এবং হাসপাতাল মোড় থেকে ফিসারি অফিস পর্যন্ত এলাকাগুলির রাস্তায় রাতে বাড়ে ছেলেদের ভিড়। পড়াশোনা বড় বালাই। কিন্তু সন্ধে নামলেই যদি মেয়েদের রাস্তায় বেরোতে গিয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয়, তা হলে আখেরে ক্যারিয়ারেই ক্ষতি— বলছেন কাকদ্বীপের পড়ুয়া মেয়েদের বাবা-মায়েরা।

অঙ্কন: নির্মাল্য প্রামাণিক

অন্য বিষয়গুলি:

state news eveteasing police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE