পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে আইনি লড়াইয়ের পথে মতুয়া সমাজ। সে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করে দিলেন মতুয়া সঙ্ঘাধিপতি তথা ভারত সরকারের মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর নিজেই। রবিবার সারা দেশ থেকে মতুয়া সমাজের নেতাদের ডেকে পাঠিয়ে বিধাননগরে ‘চিন্তন শিবির’ করলেন শান্তনু। অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে নতুন ‘আচার সংহিতা’ রচনার কথা ঘোষণা করে দিলেন। যেখানে কন্যাদান থেকে পিণ্ডদানের মতো হিন্দুধর্মের প্রচলিত অনেক আচারের বাইরে থাকার রীতিকে সুসংবদ্ধ করা হবে। মতুয়াদের নিজস্ব আচার বা রীতিতে অন্য কারও হস্তক্ষেপ রুখতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও জানালেন শান্তনু।
বড়মা বীণাপাণিদেবীর নেতৃত্বে মতুয়া ভক্তদের নিয়ে কলকাতার বুকে সমাবেশ আগেও বার দুয়েক হয়েছে। কিন্তু গোটা দেশ থেকে প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠিয়ে ‘জাতীয় মতুয়া ধর্ম চিন্তন শিবির’ স্মরণাতীত কালে প্রথম। শুধু পশ্চিমবঙ্গের মতুয়ারা নন, দেশের ১২টি রাজ্য থেকে প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন শান্তনু। হাজারখানেক প্রতিনিধিকে নিয়ে বিধাননগরের পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রেক্ষাগৃহে রবিবার সম্মেলন হল। সে সম্মেলনে সাত দফা প্রস্তাব পাশ হয়েছে ধ্বনিভোটে। আর ধ্বনিভোটের পরেই সবচেয়ে বড় ঘোষণাটা শোনা গিয়েছে। শান্তনুর ঘোষণা, মতুয়া সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক ‘আচার সংহিতা’ এবং তার আইনি মান্যতার জন্য প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে।

চিন্তন শিবিরের মঞ্চে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর, শান্তনু ঠাকুর এবং সোমা ঠাকুরকে বরণ মতুয়া মাতৃসেনার। — নিজস্ব চিত্র।
সম্মেলনে মতুয়া মহাসঙ্ঘের কেন্দ্রীয় কমিটির পদাধিকারীরা তো ছিলেনই, ছিলেন মতুয়া সমাজের আধ্যাত্মিক গুরুরা এবং বিদ্বজ্জনেরা। মতুয়া সমাজ এখনও কোন কোন ক্ষেত্রে বাধার শিকার হচ্ছে এবং মতুয়া দর্শনকে পরিপূর্ণ ও অভিন্ন আকার দেওয়ার প্রশ্নে এখনও কী কী খামতি রয়েছে, সে নিয়ে প্রথমে বিশদে আলোচনা হয় সম্মেলনে। তার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনুর আপ্তসহায়ক তথা মতুয়া মহাসঙ্ঘের সক্রিয় কর্মকর্তা তন্ময় বিশ্বাস সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেন। সে সব প্রস্তাবের মধ্যে ছিল বিভাজন বিভীষিকা দিবস এবং মরিচঝাঁপি দিবস পালনের কথা। কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাবটি একদম শেষে পেশ করেন তন্ময়। তাতে বলা হয়— বিবাহ, শ্রাদ্ধানুষ্ঠান-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান মতুয়া সমাজ নিজস্ব আচার বা রীতি মেনে করবে। এবং সেই আচার বা রীতির লিখিত রূপ মতুয়া মহাসঙ্ঘ প্রকাশ করবে। ধ্বনিভোটে প্রায় সর্বসম্মত ভাবে সব প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। তার পরেই শান্তনু আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেন।
শান্তনু বলেন, ‘‘আমরা মতুয়া সমাজের সমস্ত রীতিনীতি ও আচারকে সমন্বিত করে সংবিধান রচনা করব। মতুয়া মহাসঙ্ঘের পদাধিকারীরা এবং গোসাঁইরা মিলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেই সংবিধান তৈরি করবেন। ঠাকুরবাড়ি সেই সংবিধানকেই মান্যতা দেবে। এবং তার পরে আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাব। আমাদের রীতিনীতি আমাদের পালন করতে কেউ যেন বাধা না দেয়, সেই আর্জি আমরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে রাখব। না হলে এই বাধাদান বন্ধ হবে না।’’
সম্মেলন শেষে আনন্দবাজার অনলাইনকে শান্তনু বলেন, ‘‘মতুয়া সমাজে সমস্ত মন্ত্র বাংলায়। বিয়েতে শাঁখা-পলা, মালাবদল, সাতপাক, সিঁদুরদান সবই আছে। কিন্তু সব মন্ত্রই বাংলায়। শ্রদ্ধানুষ্ঠানেও তাই। হরিচাঁদ ঠাকুরের ছবি আর প্রয়াত ব্যক্তির ছবি রেখে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়। মন্ত্রপাঠ বাংলায় হয়।’’ তন্ময় জানালেন, ‘‘মতুয়া আচার অনুযায়ী বিয়েতে কন্যাদানের রীতি নেই। কারণ আমরা মনে করি না যে কন্যা দান করার বস্তু। তাই আমাদের যে আচার সংহিতা লেখা হবে, সেখানে কন্যাদান পর্ব বাদ দেওয়া হবে। শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানের ব্যবস্থাও বাদ দেওয়া হবে।’’
মতুয়া সমাজ কি তা হলে কুড়মিদের ধাঁচেই আন্দোলন শুরু করতে চলেছে? বাংলার জঙ্গলমহলে কুড়মিরাও ক্রমশ আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াচ্ছেন। তাঁরা হিন্দু ধর্মের বাইরে পৃথক ধর্মীয় ‘কোড’ দাবি করছেন। সে আন্দোলন কখনও কখনও হিংসাত্মক চেহারাও নিচ্ছে। শান্তনু বললেন, ‘‘একেবারেই না। আমি সম্মেলন মঞ্চে ভাষণ দেওয়ার সময়েই সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছি। আমি আবার বলছি, আমরা হিন্দুই। মতুয়া সমাজ হিন্দু ধর্মেরই একটা অংশ। কিন্তু আমাদের নিজস্ব রীতিনীতি রয়েছে। দীর্ঘ দিন যে ভাবে এই সামজকে অস্পৃশ্যতার বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আমাদের পৃথক রীতিনীতি তৈরির দরকার হয়েছিল।’’ শান্তনুর কথায়, ‘‘যে আচার, যে রীতিনীতি অনুসরণ করে এই সমাজ এত দূর এগিয়ে এল, সেই সব আচারকেই তো ধরে থাকতে হবে। তাই মতুয়া সমাজের সব রীতি ও আচারকে আমরা সংহত রূপ দেওয়ার পথে এগোচ্ছি।’’