মালদহের বৈষ্ণবনগরের বিস্ফোরণ নিয়ে দায়সারা পুলিশি তদন্তের অভিযোগ ইতিমধ্যে উঠেছে। এ বার জানা গেল, বৈষ্ণবনগরের আগে ইংরেজবাজারে সকেট বোমা বিস্ফোরণের একটি ঘটনাও পুরোপুরি চেপে গিয়েছে মালদহ জেলা পুলিশ!
তা প্রকাশ হল বর্ধমান-কাণ্ডে এনআইএ-র তদন্তের সূত্রেই। স্থানীয় সূত্রের দাবি, গত ৫ অক্টোবর ইংরেজবাজারে ওই বিস্ফোরণে তিন জন মারা যায়, গুরুতর আহত হয় তিন জন। মৃতদেহগুলো যেমন তড়িঘড়ি সরিয়ে ফেলা হয়, তেমন আহতদের কার্যত চুপিসাড়ে এনে ভর্তি করানো হয় কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। যদিও নিজেদের সূত্র মারফত খবর পেয়ে পার্ক সার্কাসের সেই হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছে এনআইএ। তারা এখন জানার চেষ্টা করছে, খাগড়াগড়-কাণ্ডের সঙ্গে ইংরেজবাজারের কোনও যোগসূত্র আছে কি না। জেলা পুলিশ অবশ্য ইংরেজবাজারে বিস্ফোরণে প্রাণহানির কথা মানতে রাজি নয়। আবার হাসপাতালের দাবি, তিন জনকে পুলিশ প্রহরায় আনা হয়েছিল। অন্য দিকে পুলিশের দাবি, তারা হাসপাতাল থেকেই ওদের ভর্তি হওয়ার কথা জানতে পেরেছে।
আর এ সব চাপান-উতোরের মাঝেই ফাঁস হয়ে গিয়েছে যে, ইংরেজবাজারে বিস্ফোরণ একটা ঘটেছিল। কিন্তু এনআইএ কী ভাবে আহতদের খোঁজ পেল?
তদন্তকারী-সূত্রের খবর: এনআইএ-র কাছে খবর এসেছিল, বর্ধমান বিস্ফোরণে গুরুতর আহত তিন ব্যক্তি পার্ক সার্কাসের হাসপাতালটিতে ভর্তি রয়েছে। সেই মতো সোমবার রাতে এনআইএ-র লোকজন ওখানে পৌঁছে যান। দু’জনের ছবি তোলার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন তদন্তকারীরা, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্রের ছবিও তুলে নিয়ে যান। আর এক আহত আইসিসিইউয়ে থাকায় তার সঙ্গে অবশ্য এনআইএ কথা বলতে পারেনি। তবে আহতদের নিরাপত্তায় রাজ্য পুলিশ ও কড়েয়া থানার পুলিশের ‘ঢিলেমি’ কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের নজর এড়ায়নি।
মঙ্গলবার পার্ক সার্কাসের হাসপাতালটিতে গিয়ে জানা গেল, আহত তিন জন ইংরেজবাজার থানা-এলাকার বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা গ্রাম নরেন্দ্রপুরের বাসিন্দা। নাম উজের শেখ, আবদুল্লাহ শেখ ও জসিম শেখ। পাঁচ তারিখ বিকেল চারটে নাগাদ গ্রামের এক আমবাগানে সকেট বোমায় ওঁরা আহত হন। তাতে তিন জন নিহত হন বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করলেও পুলিশ মানতে নারাজ। পুলিশের বক্তব্য, ঘটনাস্থলে দেহ মেলেনি। তবে আমবাগান জুড়ে পোড়া গন্ধ ছিল, আহতেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিলেন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ অক্টোবর বৈষ্ণবনগরের বাজারতি গ্রামে এক সক্রিয় তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। এবং তাতেও পুলিশ দায়সারা তদন্ত করেছে বলে অভিযোগ। ইংরেজবাজার-কাণ্ড ফাঁস হওয়ার পরে বিরোধীদের প্রশ্ন, পুলিশ কি দুই ঘটনায় অভিযুক্তদের আড়াল করতে চাইছে? মালদহ জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ তিওয়ারির মন্তব্য, “মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দু চৌধুরীই ইংরেজবাজারের কাণ্ড ধামাচাপা দিতে চাইছেন। পুুলিশ কোন সাহসে তদন্ত করবে?” সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্রের আক্ষেপ, “দলের একাংশ জড়িয়ে পড়েছে দেখে মন্ত্রী নীরব ভূমিকা পালন করছেন।” বিজেপি’র জেলা সাধারণ সম্পাদক অজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “তৃণমূল কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছে বলেই মন্ত্রী পরিকল্পিত ভাবে নীরব।”
স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুবাবু অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। “পুলিশ পুলিশের কাজ করছে। আমি এসপি’কে বলেছি আইনের শাসন বলবৎ করতে হবে।” জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের ভূমিকা কি প্রশ্নাতীত?
মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার দাবি করেছেন, কাউকে আড়াল করতে কিংবা তথ্য-প্রমাণ লোপাট করতে পুলিশ কাউকে সাহায্য করছে না। “জখম তিন জনের চিকিৎসা চলছে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে উঠলেই তাদের গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হবে।” বলেছেন এসপি। বৈষ্ণবনগর প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “ওখানে এক জনকে ধরা হয়েছে। মূল অভিযুক্ত কামাল শেখ ও তার ভাইদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”
ইংরেজবাজারে ঠিক কী হয়েছিল?
পুলিশের দাবি: দুষ্কৃতীরা মাচায় বসে বোমা বাঁধছিল, তখন বিস্ফোরণ হয়। অন্য দিকে আহতেরা এ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে দাবি করেছেন, ওঁরা আমবাগানে যখন তাস খেলছিলেন, তখন মুখে গামছা বাঁধা তিন জন মোটরবাইকে চেপে এসে বোমা ছুড়ে চম্পট দেয়। এনআইএ-কেও তাঁরা একই কথা বলেছেন। উজের শেখের চোখে স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়েছে। বুক-হাত-পা ক্ষতবিক্ষত। জানালেন, “আমি লরি ড্রাইভার। সরকারি মাল নিয়ে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করি। শেষ বার ঈদের সময়ে গিয়েছিলাম। বোমা বাঁধতে যাব কেন?” কিন্তু খামোখা তাঁদের কেউ বোমাই বা মারবে কেন? উজেরের জবাব, “তা জানি না। আমার কোনও শত্রু নেই। সৎ ভাবে রোজগার করি।”
আবদুল্লাও গাড়িচালক। তাঁরও চোখ মারাত্মক জখম। এ দিন চোখে অস্ত্রোপচার হওয়ায় তিনি কথা বলতে পারেননি। অবস্থা সবচেয়ে খারাপ জসিম শেখের। সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত। জ্ঞান নেই, আপাতত ভেন্টিলেশনে। পুলিশ-সূত্রের খবর, প্রথমে তিন জনকেই মালদহ শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ৭ তারিখে উজের ও জসিমকে কলকাতায় আনা হয়। ১০ তারিখে আনা হয় জসিমকে। মালদহ পুলিশের দাবি, তারা হাসপাতাল থেকেই তিন জনের ভর্তি হওয়ার খবর জানতে পেরেছে।
কিন্তু পুলিশের চোখ এড়িয়ে এমন মারাত্মক আহত তিন জন কলকাতায় পৌঁছল কী ভাবে?
এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy