মোফাজ্জুল শেখ ওরফে লাদেন
কথায় কথায় গ্রামবাসীদের সে বলত, “সবার সেরা আরব দেশ।” মাথায় সাদা পাগড়ি, পরনে ঢিলেঢালা সাদা পোশাক, প্রায় এক বুক দাড়ি। এ সব টুকরো মিলিয়েই ‘লাদেন’-এর জন্ম মকিমনগরে। সেই ‘লাদেন’ ওরফে মোফাজ্জুল শেখ খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্তে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) হাতে মঙ্গলবার রাতে ধরা পড়েছে জেনে নানা মতে বিভক্ত মুর্শিদাবাদের লালগোলার এই প্রত্যন্ত গ্রাম। এক দল বলছেন, “লোকটা ফেঁসে গেল।” অন্য দলের বক্তব্য, “এমন লোকের জন্যই গ্রাম বদনাম হয়েছে।”
মোফাজ্জুলকে নিয়ে খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে মকিমনগরের এক অননুমোদিত মাদ্রাসার নাম উঠে এসেছিল, যার মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা বছর বাহান্নর মোফাজ্জুল। বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত আব্দুল হাকিম, রাজিয়া বিবি, আলিমা বিবির সূত্রে মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা ছাড়াও এনআইএ-র রেডারে ছিল ওই মাদ্রাসা। এনআইএ-র বক্তব্য, এখনও পর্যন্ত তাদের মনে হচ্ছে, মকিমনগরের ওই মাদ্রাসাই পশ্চিমবঙ্গে ‘জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) পরিচালনাধীন জেহাদি প্রশিক্ষণের প্রথম ডেরা।
গোয়েন্দারা জানান, গত ২ অক্টোবর ওই মাদ্রাসায় নোটিস দিয়ে জানানো হয়, ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত ঈদের ছুটি। তার পর দিন হাজির না হলে ৫০ টাকা জরিমানা। তার পরেও হাজির না হলে প্রতিদিন জরিমানা ১০ টাকা করে। কিন্তু নোটিস দিয়েছিল যে, সেই মোফাজ্জুলই খাগড়াগড় বিস্ফোরণের দু’দিন পরে, ৪ অক্টোবর সপরিবার এলাকা ছেড়ে সরে পড়ে। তার খোঁজ শুরু করে এনআইএ।
গোয়েন্দাদের দাবি, মঙ্গলবার রাতে মকিমনগরের বাড়ি থেকেই ধরা হয় মোফাজ্জুলকে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিএসএফের লালবাগ-রৌশনবাগ দফতরে। বুধবার লালবাগ এসিজেএম আদালতে হাজির করানো হলে তাকে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় এনআইএ-র বিশেষ আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন বিচারক। আদালত চত্বরে এ দিন মোফাজ্জুলের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁর মক্কেল আত্মসমর্পণ করেছেন। যদিও সে দাবি উড়িয়ে দিয়েছে এনআইএ।
এনআইএ সূত্রের খবর, তাদের এবং বিএসএফের কর্তারা কখনও আলাদা করে, কখনও যৌথ ভাবে মোফাজ্জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বিএসএফের এক কর্তা বলেন, “মকিমনগর এলাকাটি বাংলাদেশের গোদাগাড়ি উপজেলা থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে। সীমান্তের ওই এলাকায় কাঁটাতারের বেড়াও নেই। আমাদের কাছে খবর রয়েছে যে, জেএমবি-র সঙ্গে মোফাজ্জুলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সে সবই জানতে চাওয়া হয়েছে ওর কাছে।” এনআইএ-র দাবি, মোফাজ্জুল জেএমবি-র ‘বর্ধমান মডিউল’-এর মাথা সাজিদ ওরফে মাসুদ রানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং বোমা ও অস্ত্রশস্ত্রের কারখানা গড়ার জন্য জেএমবি যে প্রথম মুর্শিদাবাদ জেলাকেই বেছে নিয়েছিল, তার বড় প্রমাণ মোফাজ্জুল ও তার প্রতিষ্ঠা করা মকিমনগর মাদ্রাসা।
এনআইএ সূত্রের দাবি, জেরায় তারা জেনেছে, খাগড়াগড়-কাণ্ডে ধৃত আব্দুল হাকিম ও তার স্ত্রী আলিমা বিবি মকিমনগরের ওই মাদ্রাসায় যাতায়াত করত। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল ঘটনার আরও দুই চক্রী হাতকাটা নাসিরুল্লা ও হবিবুর রহমানের। গত বছর দেড়েক ধরে কার্যত ওই মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করত তারাই। আব্দুল হাকিমের মতো হবিবুরও ওই মাদ্রাসায় রান্নার কাজ করত। খাগড়াগড়-কাণ্ডের পরে মকিমনগর থেকে পালিয়ে গিয়ে কখনও ঝাড়খণ্ড, কখনও ধুলিয়ানে লুকিয়ে ছিল মোফাজ্জুল। সপরিবার বাংলাদেশে পালানোর পরিকল্পনাও সে করছিল বলে দাবি গোয়েন্দাদের।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে মকিমনগরে নিজের বাড়িতে ওই মাদ্রাসা গড়ে মোফাজ্জুল। প্রথম দিকে নদিয়ার দেবগ্রামে নিজের শ্বশুরবাড়িতে থেকে লোহার ব্যবসা করত সে। বছর দশেক আগে গ্রামে ফিরে রাজমিস্ত্রির ঠিকাদারির পাশাপাশি ডিম, আলু ও পাটের কারবার শুরু করে। বছর চারেক আগে বসতবাড়ি থেকে তিনশো মিটার দূরে মাঠের মধ্যে ১২ কাঠা জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে পড়ানোর বন্দোবস্ত করে সে। শুরু থেকে সেখানে শুধু ছাত্রীরাই পড়ত। জেলা ও জেলার বাইরে থেকেও ছাত্রীরা পড়তে আসত। তাদের অনেকেই ছিল আবাসিক।
এনআইএ সূত্রের দাবি, জেরায় তারা জেনেছে, শিমুলিয়া মাদ্রাসার মতো পড়ুয়াদের জেহাদি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করা বা জঙ্গি-প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো সেখানে। পাঠ্যক্রমে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে বর্ণ পরিচয় ছিল, যাতে ‘ছ-এ ছড়া শেখো আল জেহাদের’, ‘জ-এ জেহাদি’র পাঠ দেওয়া হতো।
মকিমনগরের মোড়ে মোড়ে এ দিন জটলা। অপরিচিত মুখ দেখে এগিয়ে এলেন জনা কয়েক যুবক। শুরু হল জেরানাম, ঠিকানা, গ্রামে আসার কারণ। সাংবাদিক পরিচয়ও শুনতে চাইছিলেন না তাঁরা। কয়েক জন চিত্র সাংবাদিক সহকর্মীকে ফিরতি পথ ধরতে হয়। অনেক বোঝানোর পরে ছাড় পাওয়া গেল ‘লাদেন’-এর বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার। শোনা গেল, বাড়িতে মোফাজ্জুলের স্ত্রী ও আট সন্তান থাকলেও ভিতর থেকে তাঁরা জানালা-দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। বন্ধ দরজায় টোকা মেরে পরিচয় দিতে ভিতর থেকে পুরুষ-কণ্ঠে উড়ে এল ঝাঁঝ, “আমাদের আর কত ক্ষতি করবেন! চলে যান এখান থেকে।”
ফিরতি পথে জটলা থেকে দু’-এক জনের মন্তব্য কানে এল। তাঁরা বলছিলেন, “লাদেন ডাকতাম মজা করে। লোকটাকে ফাঁসানো হচ্ছে।” আবার একটু এগোতেই অন্য জটলা বলছে অন্য কথা। শোনা গেল, “মোফাজ্জুলের লাদেন নামটা সার্থক। গ্রাম বদনাম হয়ে গেল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy