অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
‘কে টাকা খাচ্ছে? প্রশাসনের সঙ্গে মাফিয়াদের আঁতাঁত না থাকলে এমন চলতে পারে না।’—অবৈধ বালি খাদান এবং ওভারলোডেড লরি চলাচল বন্ধ না হওয়ায় প্রশাসনিক বৈঠকে এ ভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, তার পরেও পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাঁত রেখেই চলছে বেআইনি ওই কারবার। এমনটাই অভিযোগ উঠছে।তবে, ধরনটা একটু পাল্টে গিয়েছে।
বেআইনি খাদান থেকে বালি বা পাথর তোলা, সেখান থেকে লরি করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে তা পৌঁছে দেওয়ার কাজটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়। গোটা প্রক্রিয়াটার সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনের একটা অংশের জড়িত থাকার অভিযোগ বেশ কিছু দিন ধরেই উঠছে। সঙ্গে রয়েছে শাসকদলের মদতও। বালি-পাথর মাফিয়ারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুলিশ-প্রশাসনের ওই অংশটির সাহায্য নিয়ে নির্বিবাদে এত দিন এই কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে ব্যবস্থায় একটু বদল আনা হয়েছে। এখন আর হাতে হাতে বিভিন্ন জায়গায় নয়, থোক টাকা থানাকে দিয়ে দিলেই ঝামেলা মিটে যাচ্ছে। তার বিনিময়ে মিলছে বিশেষ এক সাঙ্কেতিক এক কার্ড। সেই কার্ড দেখিয়েই খাদান থেকে রাস্তা— সর্বত্রই মিলছে ছাড়।
কেন এই কার্ডের ব্যবস্থা? এক লরিচালকের কথায়, ‘‘রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে। হাত পেতে টাকা নেওয়ার ঝুঁকি আর নিতে চাইছেন না পুলিশকর্মীরা। সর্বত্রই এখন নজরদারি। ফলে বিভিন্ন সাঙ্কেতিক চিহ্ন দেওয়া কার্ড চালু করেছে রাজ্যের বিভিন্ন থানা। ফলে, খাদান থেকে বালি অতিরিক্ত বালি নিয়ে যেতে আর কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’’
এমনই সাংকেতিক কার্ড মিলছে থানাগুলিতে। নিজস্ব চিত্র।
আইন মেনে যাঁরা এই বালি তোলার কাজ করেন, তাঁদের একটা অংশ জানাচ্ছেন, বিভিন্ন জেলায় প্রতিটি থানার আলাদা আলাদা কার্ড রয়েছে। কোনও থানার কার্ডে আঁকা রয়েছে আস্ত জাহাজ। কোনও কার্ডে আঁকা খোলা বই। কোনও কোনও কার্ডে আবার রয়েছে বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন। প্রতিমাসে থানায় টাকা জমা করে এই কার্ড কিনতে হয়। ওই কার্ড কতদিন বৈধ, সেটাও উল্লেখ করা থাকে।কারা কেনেন ওই কার্ড? ওই অংশটির দাবি, যাঁরা গাড়ি ওভারলোড করে পণ্য পরিবহণ করেন তাঁদের সঙ্গে থানার একাংশের পুলিশকর্মীদের বোঝাপড়া থাকে। কারণ বালি বা পাথর বোঝাই ওভারলোডেড লরি চেকপোস্টে আটকানো হলে ওই কার্ড দেখালেইছাড় মিলে যায়। ছাড় মেলে খাদান থেকে অতিরিক্ত বালি-পাথর তোলার ক্ষেত্রেও।
বীরভূম থেকে বাঁকুড়া, বর্ধমান থেকে হুগলি— সর্বত্রই চলছে অভিনব কায়দায় এই তোলাবাজি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক লরির চালক বলেন, “যাঁরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালান, তাঁরাই বেশি হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। অথচ যাঁরা থানায় টাকা দিয়ে ওই কার্ড কেনেন, তাঁরা দিব্যি বালি-পাথরে ওভারলোড করে লরি নিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।”
বর্ধমান-বীরভূমে নদীর বালি ও খাদানের পাথর তোলার ব্যবসা বহু কালের। নির্দিষ্ট হারে রাজস্বের বিনিময়ে খাদান বা ঘাটের ইজারা মেলে। সেখানেও বেনিয়ম হচ্ছে। যাঁরা এই খাদান বা ঘাটের ইজারা নেন, তারা অতিরিক্ত লাভের আশায় অন্য ঘাট থেকেও বালি তোলেন। সেখান থেকে বালি ওভারলোড করে পৌঁছে দেওয়া হয় মাফিয়াদের কাছে। এ কথা এখন সকলেই জানেন। কথাটা পৌঁছেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানেও। দামোদর, অজয়, কাঁসাই, সুবর্ণরেখা নদীর হাল দেখে মুখ্যমন্ত্রী রীতিমতো আতঙ্কিত। সম্প্রতি তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রশাসনিক সভায় গিয়ে রাজ্যের এসিবি (দুর্নীতি দমন শাখা)-কে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। সূত্রের খবর, যে সব সরকারি কর্মীরা এই ধরনের লেনদেনে জড়িত তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসিবি।
আরও পড়ুন: থোড়াই কেয়ার পুলিশ, ক্যামেরা! কালীঘাটে গোয়েন্দারই পকেটমার
এ বিষয়ে ‘ফেডারেশন অব ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রাক অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর যুগ্ম সচিব প্রবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই অভিযোগ সত্যি। যাঁদের কাছে একটা বা দুটো লরি রয়েছে, তাঁরা এ সব করেন না। এমন বহু সংস্থা রয়েছে, যাদের কাছে ১০০-২০০ লরি রয়েছে। তারা মাসোহারা দিয়ে থানা থেকে এই ধরনের কার্ড কিনে নিচ্ছে। ফলে তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না।”
আরও পড়ুন: অফিসের ব্যস্ত সময়ে পরপর বিভ্রাট মেট্রোয়
এ বিষয়ে রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দেননি।
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেবাংলায় খবরজানতে পড়ুন আমাদেররাজ্যবিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy