মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে আটচল্লিশটা ওয়াগন। — নিজস্ব চিত্র
সাষ্টাঙ্গে শুয়ে মহিলা। লাল পাড়, সাদা শাড়ি। হাতের লাল-সাদা ব্যাগটা মাথার সামনে বাড়ানো। আশপাশ থেকে লোকজন বলছে, ‘মাথা গুঁজে রাখো’, ‘চোখ বুজে রাখো’, ‘এই হয়ে এল’। তবে জায়গাটা দেবস্থান নয়, রেললাইন। মহিলার মাথার উপর দিয়ে ‘ঘটাংঘট, হুড়ুদ্দুম’ শব্দে পেরিয়ে যাচ্ছে মালগাড়ি। এক-এক করে আটচল্লিশটি ওয়াগন।
রবিবার শেষ বিকেলে এমনই এক ঘটনার সাক্ষী পুরুলিয়া রেল স্টেশনের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড়ানো মানুষজন। ঘটনার শেষটাও ‘মধুরেন’। মালগাড়ি সরতে দেখা গেল, নাকের উপরে সামান্য ছড়ে যাওয়া ছাড়া, কিচ্ছুটি হয়নি মহিলার। একটু থম মেরে গিয়েছিলেন। তবে জনতার সাহায্যে ঠিক হতে সময় নেননি। হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে রওনা দিয়েছেন গন্তব্যে।
জামশেদপুরের বাসিন্দা মাঝবয়সি সবিতাদেবী। পুরুলিয়ায় এসেছিলেন কাজে। রবিবার বিকেলে পুরুলিয়া স্টেশনের উত্তর দিকে তেলকলপাড়ার কাছে, লেভেল ক্রসিং থেকে একটু সরে আপ লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, লাইন পেরোবেন। ডাউন লাইনের মালগাড়ির দিকে ছিল চোখ। আপ লাইনেও মালগাড়ি আসছে দেখেননি মহিলা। প্রত্যক্ষদর্শী প্রকাশ মাহাতো, মন্টু গরাইদের দাবি, ‘‘দুটো ট্রেনই একই সঙ্গে হুইসল বাজানোয় ভদ্রমহিলা সতর্ক হননি। যত ক্ষণে খেয়াল করেন, তত ক্ষণে আপ লাইনের মালগাড়িটা ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। সরবেন, কি না, আগুপিছু করার সময় আর পাননি।’’
গতি কম থাকলেও আপ লাইনের মালগাড়ির ইঞ্জিনের কাউক্যাচারে ধাক্কা খেয়ে সবিতাকে দু’লাইনের মাঝে পড়ে যেতে দেখেন পুরুলিয়া স্টেশনের রেলকর্মী তাপস বন্দোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ধাক্কা লাগতে ভাবলাম, হয়ে গেল! তার পর দেখি, পড়েছেন দু’লাইনের ফাঁকে। অল্প মাথা নাড়ানো দেখে বুঝলাম প্রাণ আছে। তখন ওঁকে বলি, ‘একদম নড়বেন না। মুখ গুঁজে থাকুন’। বলেছিলাম বটে, কিন্তু ভয় ছিল, মাথার উপর দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে—এই আতঙ্কেই ওঁর না কিছু হয়ে যায়!’’
প্রকাশ মাহাতোরা অবশ্য হাল ছাড়েননি। মালগাড়ির চাকার কর্কশ শব্দের উপরে গলা চড়িয়ে সমানে চেঁচিয়ে গিয়েছেন, ‘‘চোখ বুজে রাখো একদম। আর একটু। ভয় কোরো না। কার মুখ দেখে উঠেছিলে গো, নতুন জীবন পেলে একেবারে? আর একটু... এই হয়ে এল!’’
পুরুলিয়ার স্টেশন ম্যানেজার অমিতাভ মজুমদার জানান, মহিলার উপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার ঘটনা দেখে ডাউন লাইন দিয়ে আদ্রামুখী মালগাড়ির গার্ড ওয়াকিটকিটা হাতে নিয়েছিলেন, কাটা পড়ার খবরটা জানাবেন বলে। তত ক্ষণে অবশ্য মহিলাকে ঘিরে ফেলেছে জনতা। সাহায্যে এগিয়ে এসেছে একাধিক হাত আর কাঁধ। সবিতা উঠে দাঁড়িয়েছেন। হাতে ‘স্নুপি’ লেখা লাল-সাদা ব্যাগ।
জনতা গোড়া থেকেই রেল রক্ষী বাহিনী (আরপিএফ) বা রেল পুলিশের ভরসায় না থেকে মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছিল। কিছুটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন সবিতাও। পরে কয়েক পা হেঁটেই সম্বিত ফিরে পান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বলেন, ‘একটু তাড়া আছে আমার। টাটানগর যেতে হবে। এক আত্মীয় সেখানে মৃত্যুশয্যায়’। হাসপাতালে আর যেতে চাননি তিনি।
আরপিএফের পুরুলিয়ার আধিকারিক নারায়ণ দত্ত জানান, বাহিনীর জওয়ানেরা সবিতাদেবীকে সন্ধ্যায় টাটানগরগামী ট্রেনে তুলে দেন। তখনও প্ল্যাটফর্মে হাজির জনতা। ট্রেন ছাড়ার আগে প্রকাশ, মন্টুদের হাত ধরে সবিতা বলে গিয়েছেন, ‘‘নতুন জন্ম হল আমার! আপনারা সাহস না জোগালে, কী যে হতো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy