সারাজীবনের সঞ্চয় মেডেল হাতে বাদল রায়। —নিজস্ব চিত্র।
জীর্ণ নাইলনের ব্যাগটা ভর্তি মেডেল, পদক। কোনওটা জাতীয় স্তরের কোনওটা আবার আন্তর্জাতিক। কোনওটা সোনার, কোনওটা ব্রোঞ্জ। ওরা সবাই অন্তহীন দৌড়ের সাক্ষী। এ সবই এখন অর্থহীন মনে হয় বাদল রায়ের কাছ। ৭৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী এই ক্রীড়াবিদ এখনও স্থায়ী জীবিকার সংস্থান করে উঠতে পারেননি। পাননি প্রশাসনিক বা বেসরকারি সাহায্য।
বছর চল্লিশের বাদলবাবু স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন নাকাশিপাড়ার হরিনারায়ণপুর গ্রামে। ক্ষুন্নিবৃত্তির একমাত্র অবলম্বন খেত মজুরি। হাজার চেষ্টা করেও মেলেনি সরকারি সহায়তা। বাদলবাবু বলেন, “স্থানীয় সাংসদ থেকে শুরু করে নদিয়ার জেলাশাসক, তৃণমূল নেতা মুকুল রায় সকলের কাছেই চাকরি চেয়ে চিঠি দিয়েছি। বেশিরভাগ চিঠিরই কোনও জবাব আসেনি। তবে ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে একটা চিঠি পেয়েছিলাম।” সে চিঠিতে ক্রীড়াবিদদের জন্য জাতীয় জনকল্যাণকামী তহবিলের অর্থে কীভাবে দুঃস্থ খেলোয়াড়দের সাহায্য করা হয় তার ফিরিস্তি ছিল। বার্ষিক ২ লাখ টাকার কম আয়ের জাতীয় বা আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে ক্রীড়াবিদরা এই তহবিলের অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকেন। কিন্তু অনেক তদ্বির করেও তা পাননি প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী এই দৌড়বিদ।
খুব ছোটবেলা থেকেই দৌড়নোর শখ ছিল বাদলবাবুর। জন্ম থেকেই তাঁর আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তবু হার মানেননি। শারীরিক প্রতিবন্ধতার পাশাপাশি দারিদ্রকে দূরে সরিয়ে দৌড়ে গিয়েছেন শুধু। স্কুলে পড়াকালীন ১৫০০ মিটার দৌড়ে নাকাশিপাড়া জোনে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। তখনই নজরে পড়ে যান দেবগ্রামের খেলা-পাগল মানুষ ধীরেন দাসের। তাঁর কাছেই বিনা পারিশ্রমিকে কোচিং নিতে শুরু করেন বাদলবাবু। তারপর ধীরেন স্যারই হয়ে গেছেন বাদলবাবুর ‘ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড’। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ১৯৮৯ সালে স্থানীয় শ্রীমা ক্রিকেট ক্লাব আয়োজিত আন্তঃজেলা বার্ষিক ম্যারাথনে পঞ্চম স্থান দখল করেন।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০০৭ সালে চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্তরের প্রতিবন্ধীদের জন্য আয়োজিত ১০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ২০০৮ সালে চেন্নাইতেই ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস অ্যান্ড ট্যালেন্ট মিট ফর দ্য চ্যালেঞ্জড’ অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদের অলিম্পিকে দেশের জন্য ছিনিয়ে আনেন ব্রোঞ্জ পদকটি। ২০০৯-এ জয়পুরে জাতীয় প্যারা অলিম্পিকে ৮০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ পদক, পরের বছর চণ্ডীগড়ের প্যারা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক দখলে রাখেন হরিনারায়ণপুরের এই প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ। শুধু তাই নয় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেদিনীপুরের নারায়নগড়ে আট কিলোমিটার সারা বাংলা রোড রেসে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন বাদল রায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংস্থার তরফে আয়োজিত একাধিক ম্যারাথনে সাফল্যের সঙ্গে দৌড়েছেন তিনি। বিবেকানন্দের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কন্যাকুমারী থেকে কলকাতা পর্যন্ত মশাল অলিম্পিকের ২৬০০ কিলোমিটার ম্যারাথনেও যোগ দেন।
সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও কোনও আর্থিক সহায়তা জোটেনি। এমনকী স্থানীয় পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী ভাতাটুকুও জোটে না। কারণ তিনি ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী নন। বাদলবাবুর স্ত্রী সুচিত্রা রায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। তিনি বলেন, “অঙ্গনওয়াড়ির কাজ আজ আছে কাল নেই। আমাদের দু’জনেরই রোজগারের কোনও স্থিরতা নেই। কাল কী খাব জানি না।”
বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবারে এই মাস খানেক হল বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছে। এক চিলতে টিনের চালা ঘুপচি ঘরে একটা বাল্ব জ্বলে। এটুকুই আশার আলো। তা বাদে দু’চোখে হতাশার অন্ধকার মেখে বাদলবাবু তাকিয়ে থাকেন ব্যাগ ভর্তি পদকগুলোর দিকে। কখনও নিজের মনেই বলে উঠেন, “ও সব পদকের কী মূল্য রয়েছে? এখন পেটের ভাত জোগাড় করাই দায় হয়ে পড়ছে। একটু সাহায্য পেলে দৌড়টা চালিয়ে যেতে পারতাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy