শপথের দিনে। বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের ছবি।
-- ওরে, টিভির সাউন্ডটা আর একটু বাড়িয়ে দে...
-- চুপ, চুপ, ওই দ্যাখ, মোদী এবার...
নড়বড়ে টেবিলের উপরে রাখা ১৪ ইঞ্চি কালার টিভির স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর মুখ। টিনের চাল আর পাটকাঠির বেড়া দেওয়া একচিলতে চায়ের দোকানে তখন পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। প্রায় অন্ধকার ওই দোকানের মাচায় বসে জমাট ভিড়টা এক মনে শুনছে, ‘ম্যায় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী ঈশ্বরকি শপথ...।’
ঠিক তখনই চায়ের কেটলি আর পলকা প্লাস্টিকের কাপ হাতে কেউ যেন কানের পাশে বলে উঠল, “আর এক কাপ চা দিই তাহলে। উঁহু, টাকা নিয়ে একদম ভাববেন না। আজকের চা মোদীর নামে। কোনও পয়সা লাগবে না। এক্কেবারে ফ্রি।” সোমবার সন্ধ্যায় টিভি থেকে ততক্ষণে চোখগুলো ঘুরে গিয়েছে কেটলি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে। করিমপুর নাটনা মোড়ের চায়ের দোকানদার তন্ময় নাথকে চেনেন না এমন লোক এ তল্লাটে কমই আছেন। তাঁর দোকানে চায়ের সঙ্গে টা-এর থেকেও টিভির কারণেই সকাল-সন্ধে ভিড় হয় ভালই। কিন্তু আজ কোন আনন্দে চা একেবারে বিনা পয়সায়?
“সত্যিই আজ খুব আনন্দ হচ্ছে। অভাবের সংসারে তেমন লেখাপড়া শিখতে পারিনি। চায়ের দোকান চালাই শুনে অনেকেই নাক কুঁচকেছে। তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হত। আজ মোদী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই জয় আমার, আমার মতো চা বিক্রেতাদের।” হাসিমুখে কথা বলতে বলতেও চোখের জল আড়াল করতে পারলেন না বছর আটত্রিশের ওই যুবক।
এদিন সন্ধ্যায় যাঁরা তন্ময়ের দোকানে এসেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ আচমকা এমন ঘটনায় অবাক হয়েছেন বইকি! খেতের কাজ কিংবা পাটের গুদামে কাজ শেষ করে দোকানের মাচায় গুছিয়ে বসেছিলেন হাকিম মণ্ডল, শ্যামল বিশ্বাস, কালু শেখ, নারায়ণ বিশ্বাসরা। তাঁরা সমস্বরে বলছেন, “মোদী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বলে তন্ময়দা যে এভাবে চা খাইয়ে দেবে প্রথমে তো বিশ্বাসই হয়নি। পরে চায়ের দাম দিতে গেলেও তন্ময়দা ফিরিয়ে দিয়েছেন।” মোদীতে মজে থাকা স্বামীকে কিছু বলবেন না? স্ত্রী অনুরূপা বলছেন, “দুই মেয়ে নিয়ে আমাদের চার জনের সংসার। কোনওরকমে চলে যায়। এমন তো আর ও রোজ করে না। একটা দিন যদি সবাইকে চা খাইয়ে দিয়ে মানুষটা একটু আনন্দ পায় তাতে ক্ষতি কী!”
এ দিন ফার্মের মোড়ের পিনাকী মণ্ডল, নাটনার মনা মণ্ডলের চায়ের দোকানেও সন্ধ্যার পর থেকে ভিড় উপচে পড়েছিল। পিনাকীর চায়ের দোকানে টিভি নেই। কিন্তু এদিন বাড়ি থেকে তিনি টিভি নিয়ে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে প্রায় দু’শো কাপ চা তিনিও বিলিয়েছেন। ভিড় হয়েছিল মনার দোকানেও। তবে তিনি অবশ্য আবেগের থেকেও বেশি মন দিয়েছিলেন ব্যবসাতে। হাসতে হাসতেই মনা বলছেন, “আজ দাদা, ব্যবসা কিন্তু ভালই হয়েছে। মোদীর শপথ, তার উপরে এক পশলা বৃষ্টির পর আবহাওয়াটাও ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। ফলে কাপের পর কাপ চা উড়ে গিয়েছে।” তন্ময়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভিড় থেকেই ধেয়ে এল খোঁচাটা, “কী রে তন্ময়, আমরা তো জানতাম তুই দিদির লোক। কিন্তু এখন তো দেখছি হাওয়া অন্য দিকে...।” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসতে হাসতেই তন্ময়ের জবাব, “দল-টল নয় দাদা, আসল কথাটা হচ্ছে দম। দম থাকলে একজন চা বিক্রেতাও যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে সেটা তো নরেন্দ্র মোদী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।”
দিল্লি থেকে করিমপুরের দূরত্ব অনেক। কিন্তু মোদী-ম্যাজিকে বুঁদ তন্ময়দের মতো আম-আদমিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy