Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘ডাইনি’ দেগে শুরু হল প্রহার

পৈতৃক নয় শতক বসত-জমি আর ৪০ শতক ধানি জমি। তাই নিয়েই বিবাদ। কানাঘুঁষো ছড়িয়ে পড়ে, দুই ভাইকে ফাঁকি দিয়ে বোনেরা ছোট ভাইকে তাদের জমির অংশ দিয়ে দিচ্ছে।

হাসপাতালে গৌরী। —নিজস্ব চিত্র

হাসপাতালে গৌরী। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
নওদা শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৪১
Share: Save:

পৈতৃক নয় শতক বসত-জমি আর ৪০ শতক ধানি জমি। তাই নিয়েই বিবাদ। কানাঘুঁষো ছড়িয়ে পড়ে, দুই ভাইকে ফাঁকি দিয়ে বোনেরা ছোট ভাইকে তাদের জমির অংশ দিয়ে দিচ্ছে।

অভিযোগ, এই নিয়ে গণ্ডগোলের সূত্রপাত। শত চেষ্টাতেও বোনেদের দলে টানতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের বৌকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে মারধর করল ভাসুররা। সাক্ষী থাকল নওদার ঘোড়ামারা গ্রাম। গুরুতর জখম অবস্থায় ৪২ বছর বয়সী গৌরী দাসকে রবিবার দুপুরে আমতলা গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে সোমবার তাঁকে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। সোমবার সকালে হাসপাতালে সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে তাঁর স্যালাইন চালু করা হয়েছে। বললেন, ‘‘সারা পিঠে কালসিটে। শুতেও পারছি না।’’

সোমবার নওদার ঘোড়ামারার দাসপাড়ায় যেতেই গ্রামের বাসিন্দারা সমস্বরে বললেন, ‘‘ও ডাইনির ঘটনা, এই মাটির রাস্তা দিয়ে ডান দিকের প্রথম বাড়ি।’’ ঘটনাস্থলে পৌঁছতে জানা গেল, পৈতৃক জমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে বিবাদ। মোট ৮ ভাইবোনের মধ্যে তিন ভাই বল্টু দাস, মন্টু দাস ও শম্ভু দাসকে তাঁদের বাবা ফণী দাস মারা যাওয়ার আগে ৯ শতক জায়গায় তিনটি ভাগে বাড়ি তৈরির বন্দোবস্ত করে দিয়ে যায়। কিন্তু মৃত্যুর পর পাঁচ বোন বাড়ি ও জমির ভাগ চেয়ে বসে। ভাইদের অভিযোগ, পাঁচ বোনের মধ্যে দুই বোন ছোট ভাই শম্ভু দাসকে গোপনে তাদের অংশ দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছে। সেই থেকেই দুই ভাই এক দিকে, অপর ভাই অন্য দিকে।

এর পরই এক মাস হল বড় ভাই বল্টু দাসের বাড়ির লোকজন লাগাতার দাবি করতে থাকে, তাদের প্রত্যকের নানান রকমের ব্যামো লেগেই থাকছে। ‘রোগ সারাতে’ রবিবার দুপুরে পাশের গ্রাম থেকে গুনীন ডেকে আনা হয়। সে এসে জানায়, ‘বাণ’ মারা হয়েছে। বল্টুর পরিবারের দাবি, গুনীনই ইঙ্গিত করে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী গৌরী দাস ‘ডাইনি’। সে-ই এই কাজ করেছে। গ্রামবাসীদেরই একাংশ গুনীনের এ হেন ‘দাওয়াই’-এর কথা জানতে পেরে সোজা চলে যান দাস-বাড়িতে। বল্টু দাসের বাড়ি থেকে গুনীন বেরোতেই গ্রামে কালীমন্দিরের কাছে তার পর পথ আটকায় গ্রামের কয়েক জন মহিলা। তার মধ্যে ছিলেন গৌরী দাসও। তাঁরা চেপে ধরেন, কী ভাবে কাউকে ডাইনি অপবাদ দিচ্ছে সে। সোজাসুজি প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি ডাইনি বললেন, প্রমাণ দিলেন না? প্রমাণ না দিলে, বাড়ি যেতে দেওয়া হবে না।’’ প্রমাণ তো দূরের কথা, গুনীন হাত কচলাতে থাকে। বেগতিক বুঝে গুনীন পালানোর চেষ্টা করে। শেষে বল্টু দাস, মন্টু দাস ও তাদের বাড়ির লোকেরাই গৌরীকে সামনে পেয়ে শাবল দিয়ে পেটাতে থাকে। তার পর লাঠি-ঘুসি-কিল-চড় মারা হয়। তারা সকলে বলে, ‘‘ডাইনিকে আজ আমরা মেরে ফেলব।’’ গৌরী দাসকে বাঁচাতে গিয়ে তাঁর স্বামী শম্ভু দাস ও পড়শিরা আক্রান্ত হন। পরে গ্রামবাসীদের প্রচেষ্টায় গুরুতর অবস্থায় গৌরী দাসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ দিন বল্টু দাসের স্ত্রী অঞ্জলি দাস বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির কর্তারও নাকে লেগেছে। আমাদেরও কয়েক জন জখম। আমরাও পুলিশকে জানিয়েছি।’’ঘটনার নিন্দা করেছে‌ন নওদার বিধায়ক আবু তাহের খান। তিনি বলেন, ‘‘এ যুগে ডাইনি অপবাদ দিয়ে মারধরের কথা ভাবা যায় না। পুলিশ এর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক।’’ নওদার ওসি উৎপল দাস জানান, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা সমাজকল্যাণ আধিকারিক শ্যামলকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘এ সবের মোকাবিলা করতে স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ছোট ছোট সচেতনতা শিবির করতে হবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Rumor Lynch Woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE