কতগুলি বাম্পার পেরোলে তবে কৃষ্ণনগর পৌঁছনো যায়?
করিমপুর-কৃষ্ণনগর সড়কে রোজ যাতায়াত করেন, এমন কারও কাছে প্রশ্নটা রাখুন, চকিতে উত্তর পাবেন ৮২/৫৪।
জেলা সদর থেকে সীমান্তের ওই মহকুমা শহরে ৮২ কিলোমিটার রাস্তায় বাস্তবিকই স্পিড ব্রেকারের সংখ্যা ৫৪। আর সেই হার্ডল ক্রমান্বয়ে টপকে যেতে যেতে কী হয়েছে?
নিরন্তর ঝাঁকুনিতে সন্তান প্রসব, মাঝবয়সীর হার্ট অ্যাটাক, নিত্যযাত্রীর মাজায় ব্যাথা। ওই রুটে যাঁরা বাস চালান তাঁদের অভিজ্ঞতা বলছে— গত ছ’মাসে এমন কোনও বাস নেই যার অ্যাক্সেল অন্তত একবার না একবার চোট খেয়েছে, ভেঙে গিয়েছে সাসপেন্সর, দেহ রেখেছে শকার (শক অ্যবজর্ভার)।
দেশের রাস্তাঘাটে যান চলাচলের গড় গতি যেখানে ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, করিমপুর-কৃষ্ণনগর রুটে সেই গতি এখন নেমে এসেছে বিশ-পঁচিশে। কেন এমন গতিহারা ওই রাজ্য সড়ক?
নদিয়ার পরিবহণ দফতরের এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘দোষটা সড়ক কিংবা চালকদের নয়। বরং স্থানীয় গ্রামবাসীদের আবদারের খেসারত বললে কম বলা হয় না।’’ বছর দশেক আগেও ওই পথে গতি রোখার এমন তোড়জোড় অবশ্য ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, তখনও এ পথে এত ‘বাম্পার’ ছিল না। ব্যাঙের ছাতার মতো তা গজাল কী করে?
করিমপুরের এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘‘গ্রামবাসীদের তোয়াজ করতে গিয়েই আজ এই হাল হয়েছে। তবে দুর্ঘটনা রুখে দেওয়ার দাওয়াই কিন্তু স্পিড ব্রেকার নয়। চালক ও পথচারী সচেতন না হলে দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল।’’
পুলিশের হিসেবে, গত ছ’মাসে করিমপুর কৃষ্ণনগর রাজ্য সড়কে চাপড়ার এলেমনগর, ন’মাইল-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ২০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ জানাচ্ছে, একটি করে দুর্ঘটনা এবং পথ অবরোধ করে গ্রামবাসীদের নাছোড় দাবি— ‘বাম্পার চাই’।
ঝামেলা এড়াতে সেই আবদারে সায় দিয়েছে কখনও পূর্ত দফতর কখনও বা পঞ্চায়েত। উটের মতো অজস্র কুঁজ নিয়ে তাই পড়ে রয়েছে করিমপুর-কৃষ্ণনগর রাজ্য সড়ক। গয়ংগচ্ছ মনোভাব যে প্রশাসনেরও তা স্পষ্ট নদিয়ার জেলাশাসক বিজয় ভারতীর কথাতেও। তিনি মেনে নিচ্ছেন, ‘‘স্থানীয় মানুষের দাবি মেনেই ওই রাস্তায় স্পিড ব্রেকার তৈরি হয়েছে। হয়তো তা নিয়ে কিঞ্চিৎ অসুবিধাও আছে। তবে, আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা তো আপত্তি জানাচ্ছেন না।’’
আবার সব জায়গায় যে দুর্ঘটনার পরেই স্পিড ব্রেকার তৈরি হয়েছে, এমনটাও নয়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, আগে থেকেই তাঁরা স্পিড ব্রেকার তৈরি করিয়ে রেখেছেন যাতে গাড়ি আস্তে চলে ও দুর্ঘটনা না ঘটে। বাস চালকদের একাংশ আবার জানাচ্ছেন, ফাঁকা মাঠের মধ্যে জনবসতি রয়েছে। অথচ বাসস্টপ বেশ কিছুটা দূরে। ফলে বাড়ির কাছেই যাতে বাস থামে তার জন্যও তৈরি হয়েছে ‘বাম্পার’। সে কথা কবুল করছে পূর্ত দফতরও। দফতরের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, কারও কোনও অনুমতি ছাড়াই বেশ কয়েকটি জায়গায় স্পিড ব্রেকার তৈরি করে ফেলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই!
বাম্পার যে কী ভয়ঙ্কর বস্তু, তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখবেন করিমপুরের রুপালী জোয়ারদার। প্রসব যন্ত্রণা নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন— ‘এ তো সিজার কেস।’ তড়িঘড়ি রুপালীকে নিয়ে তাঁর বাড়ির লোকজন রওনা দেন কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে।
রাস্তার উপরে একের পর এক স্পিড ব্রেকারের ঝাঁকুনিতে কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর আগেই গাড়ির মধ্যেই কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। রুপালীর এক আত্মীয় চায়না জোয়ারদার বলছেন, ‘‘বাপরে বাম্পার! রুপালী ও তার সন্তানের যে কিছু হয়নি সেই রক্ষে।’’
বেশ কয়েক মাস আগে এক দম্পতি মোটরবাইকে তেহট্ট থেকে করিমপুর ফিরছিলেন। বেতাই এলাকায় একটি স্পিড ব্রেকারে ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে মৃত্যু হয় মহিলার। গুরুতর জখম হন তাঁর স্বামীও। অভিযোগ, সব জেনেও প্রশাসন নীরব দর্শক।
নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক অশোক ঘোষ বলছেন, ‘‘এত বাম্পারের কারণে বাসের গতি তো বাড়ানোই যাচ্ছে না। উল্টে নিত্যদিন গাড়ির যন্ত্রাংশ ভাঙছে। এ বার আমরা ধর্মঘট শুরু করব।’’
সহ-প্রতিবেদন: সামসুদ্দিন বিশ্বাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy