ফেরদোস
তিনি বক্তৃতা করেন না। গানের ঝোঁকে শূন্যে মুঠি ছোড়েন না। কবিতা বলেন না। চুপচাপ বসে মাথাও নাড়ান না।
তিনি জঞ্জাল কোড়ান।
রোজ আনাজ বিক্রির কাজ সেরে তিনি চলে আসেন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে পলাশির সিএএ-এনআরসি বিরোধী ধর্নামঞ্চে। নেতাজি সুভাষের নামাঙ্কিত ওই মঞ্চে দিনভর নানা রকম কর্মসূচি চলে। আর নিজের মনে মঞ্চের চারপাশে আবর্জনা সাফ করে চলেন ষাট ছুঁই-ছুঁই ফেরদোস মণ্ডল। নীরবে। তাঁর কথায়, ‘‘আমি তো আর মঞ্চে উঠে কিছু বলতে পারব না। তাই নিজের মতো করে যেটা পারি, সেটাই করি।’’
টানা একটা মাস এই তাঁর রুটিন। গত ২৫ জানুয়ারি পলাশিতে ধর্নামঞ্চ শুরুর দিনটি থেকে রোজ আসছেন ফেরদোস। আশপাশের গ্রাম থেকে আসছেন তাঁর মতো বহু মানুষ। বাইরে থেকেও আসছেন। কেউ নদিয়ারই অন্য প্রান্ত থেকে, কেউ মুর্শিদাবাদ থেকে, কেউ কলকাতা থেকে। শ’য়ে-শ’য়ে মানুষের জমায়েত যেখানে, সেখানে এটা-সেটা নানা জিনিস তো ছড়িয়ে থাকবেই। কাগজের ঠোঙা, প্লাস্টিকের প্যাকেট, আরও কত কী! কিন্তু পর দিন বিকালের আগেই সব আবার সাফসুতরো। কোন ভূতে যে এ সব করে যাচ্ছে, বাইরের লোকজন টেরও পান না। জানেন কেবল রোজ সমবেত হওয়া ধর্নাকারীরা।
সোমবারও ধর্নামঞ্চে গিয়ে দেখা পাওয়া গেল তাঁর। বৃদ্ধ ফেরদোস তখন মঞ্চের চারদিক থেকে চায়ের ভাঁড়, ক্যারিব্যাগ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার খানিক বাদেই ঝাঁটা নিয়ে বসার জায়গায় পাতা ত্রিপল ঝাঁট দিচ্ছেন। ধর্নামঞ্চ থেকে একটু দূরে তাঁর অস্থায়ী দোকান আনাজের। ধর্না কমিটির লোকজনই জানান, যখন থেকে মঞ্চে অনেক লোকজন আসতে লাগল, সে দিন থেকেই ফেরদোস নিজে সাফাই করার দায়িত্ব নিয়েছেন। সকাল থেকে আনাজ বিক্রি করে দুপুরে চলে আসেন মঞ্চের কাছে। একপ্রস্ত সাফাই সেরে বাড়ি চলে যান। স্নান-খাওয়া আবার ফিরে আসেন। তখন ফুরসতে একটু ধীরে-সুস্থে বসে বক্তৃতা শোনেন। যার বক্তব্য ভাল লাগে, মঞ্চে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদও করেন।
ধর্নামঞ্চ যে এলাকায় তৈরি হয়েছে, তার পাশের পাড়া জানকীনগরে ফেরদোসের বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিন ছেলেই এখনও লেখাপড়া করছে। নিজে পড়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়ার দিকে তাঁর খুব নজর। স্কুলের আঙিনা না মাড়ালেও ফেরদোস কিন্তু সৎ ও পরোপকারী মানুষ হিসেবেই এলাকায় পরিচিত। স্থানীয় বাসিন্দা মেহেবুর রহমানের কথায়, ‘‘পাড়ায় কারও বিপদ হয়েছে শুনলেই উনি দৌড়ে যান। সকলেই ওঁকে যেমন বিশ্বাস করেন, তেমনই ভালবাসেন।’
ধর্নামঞ্চ কমিটির পক্ষ থেকে কামালউদ্দিন শেখ বলেন, ‘‘মানুষটা একটা অভাবনীয় চরিত্র বলা যায়। আমরা কিছুই ওঁকে বলিনি কোনও দিন। উনি নিজে থেকেই এসে স্বেচ্ছায় পরিষ্কার করে যাচ্ছেন। ওঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। উনি আমাদের প্রেরণা।’ আর ফেরদোস বলছেন, ‘‘এখানে এত লোক আসছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে না? বাড়িতে লোক আসবে জানলেও তো ঘরদোর সাফসুতরো করে রাখি।’’ নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy