ঠাকুর নিয়ে বাড়ির পথে।
বৈষ্ণব দর্শনে রাসের হাজারো ব্যাখ্যা। ভজনকুঠিতে রাস পূর্ণিমার উদ্বোধনের নানান বিধি রয়েছে।
চৈতন্যধাম নবদ্বীপে কিন্তু রাস আসে অন্যভাবে। পূর্ণিমার ভরা চাঁদের রাতে বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো। সঙ্গে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে ওঠা উৎসবের এক উচ্চকিত দামাল উদযাপন। সময় চুম্বকে এই হল নবদ্বীপের রাস।
বৈষ্ণবদের প্রিয় উৎসব রাস বহু প্রাচীন। চৈতন্যদেবের আগে সে উৎসবের রূপ ছিল ভিন্ন। ইতিহাস বলছে, চৈতন্যযুগে রাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে। মহাপ্রভুর প্রভাবে যাবতীয় বৈষ্ণবীয় উৎসবের মতো আমূল বদলালো নবদ্বীপের রাসের রূপও। কিন্তু, বৈষ্ণবীয় ধারা থেকে স্বতন্ত্র নবদ্বীপের রাসের শুরু নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্ব কালে।
১৭৫২ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে। শক্তির উপাসক কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিপুজোর প্রসার ঘটাতে রাসপূর্ণিমাকে বেছে নিলেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।
নবদ্বীপের হরিসভাপাড়ায় ভদ্রকালী।
গুটি গুটি পায়ে সেই রাস উৎসব তিনশ’র পথে পা বাড়িয়েছে। কালের নিয়মে উৎসবের গা থেকে খসে পড়েছে প্রাচীনত্ব। সময়ের ছোঁয়াচ লেগেছে মূর্তি থেকে মণ্ডপ, আলোকসজ্জা থেকে শোভাযাত্রা সবেতেই। সুউচ্চ প্রতিমা ছিল একসময় নবদ্বীপের রাসের প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু আবার বদল আসছে নবদ্বীপের রাসে। বিশালাকার প্রতিমা নয়, নবদ্বীপের রাসের মন এখন থিমের পানে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে রেলের গাড়ি। গতিতে টালমাটাল যাত্রীরা। এক সময় কমে আসে গতি। ফিঁকে হয় অন্ধকার। যাত্রীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাধা-কৃষ্ণের অপূর্ব যুগলমূর্তি। গত বছর রাসে থিমের খেলায় চমকে দিয়েছিল নবদ্বীপ মালঞ্চপাড়া ইয়ং-ব্লাড ক্লাব। ‘জনপ্রিয়’ ক্লাব দর্শনার্থীদের সটান তুলে দিয়েছিল কয়েকশো ফূট উঁচু পাহাড় চূড়োয়। যেখানে অবিরাম ঝ়ড়েছিল তুষার। আবার মুক্তিসূর্য ক্লাব জিপিআরএসের মাধ্যমে আলোকসজ্জা নিয়ন্ত্রন করে চমকে দিয়েছিল।
এ বার থিমের রমরমা আরও এক ধাপ বেড়েছে। ‘মুক্তিসূর্য’ তাদের উৎসব প্রাঙ্গণে তুলে আনছে এক টুকরো পুরী-সহ জগন্নাথ দেবের অনুষঙ্গ। থিম শিল্পী রাজু সুত্রধর জানান, গোটা থিমের তিনটি অংশ। ওড়িশার রঘুরাজপুরের উৎকল ঘরানার পটের সঙ্গে বাংলার পটের শৈলিকে মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপের বাইরের দিক। যার আদলটা কোনারকের সূর্য মন্দিরের মতো।
রাসের প্রস্তুতি করিমপুরে।
প্রবেশদ্বারে অতিকায় ধাতব রথে কয়েক ফুট উচ্চতার জগন্নাথ দেবের দারু বিগ্রহ। সেখানে পুরীর মন্দিরের পরিবেশ। পুজোর জন্য পুরোহিত থেকে ফুল-মালার দোকান সবই আসল। এমনকী, পাণ্ডার ‘ধাই কিরি কিরি’ লাঠির ঘা পড়বে পিঠে। মূল মণ্ডপে দর্শন মিলবে নীলাচল গামী মহাপ্রভুর ব্যাকুল রূপের।
‘ইয়ং ব্লাড’-এর এবারের থিম পুতুল খেলা। একেবারে সেকালের পুতুল খেলার মধ্যে দিয়ে সবুজায়নের কথা বলছেন বনদেবীরা। মণ্ডপে বৌদ্ধ স্তুপের আদল। ভারতমাতা বারোয়ারির থিমে এবার জাতীয় পাখি ময়ূর। গোটা মণ্ডপটি যেন একটি ময়ূর। ভিতরে অভয়ারণ্যের পরিবেশ। জল-জঙ্গল সাজানো মণ্ডপ মানুষের নজর কাড়বেই। জনপ্রিয় ক্লাব এবার রাসে মঙ্গলে নিয়ে যাচ্ছেন। ওঁদের ক্যাচলাইন— “অনেক বছর তো রাসে নবদ্বীপে কাটালেন। এবার চলুন না, মঙ্গলে যাই।”
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য, কল্লোল প্রামাণিক, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy