গণপিটুনির হাত থেকে এক যুবককে বাঁচাতে গিয়ে গ্রামবাসীর হাতে মার খেলেন পোল্লাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। জলঙ্গি থানার আলিনগর গ্রামের ওই ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মীও প্রহৃত হ’ন। তাঁদের মধ্যে এক পুলিশকর্মী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গুরুতর আহত অবস্থায় ডোমকল মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে আলিনগরের ওই যুবককেও। পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে এসে ওই জনতাদের তাড়া খেয়ে স্কুলের অফিসে ঢুকে কোনও মতে রক্ষা পান জলঙ্গির বিডিও।
পুলিশের বক্তব্য, ভিত্তিহীন গুজবের জন্যই এ দিনের এত বড় ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “দিন কয়েক আগে ফোনে একজন জানায়, রানিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোটরবাইকে ছেলেধরা এসেছে। সে স্কুলের তিন পড়ুয়াকে চকোলেট খাইয়ে তুলে নিয়ে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারি এরকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি।”
গত কয়েক দিন ধরেই ছেলেধরার হানার গুজবে জেরবার ডোমকল ও লালগোলার বেশ কয়েকটি এলাকা। কোথাও কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। স্কুলে এসে কোনও ছাত্র নিখোঁজ হয়েছে বলেও কারও জানা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুলিশ এসে খোঁজাখুঁজি করেও সন্দেহজনক কারও দেখা পায়নি। তারপরেও ছেলেধরার গুজব এমনই ভয় ছড়িয়েছে, যে শিকেয় উঠেছে ডোমকল ও লালগোলা এলাকার বেশ কয়েকটি স্কুলের পঠনপাঠন।
মঙ্গলবার জলঙ্গির জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু গ্রামবাসী এসে হইচই করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ছেলেধরা এসে স্কুল থেকে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুই করছে না। স্কুলের প্রধানশিক্ষক মৃদুল মণ্ডল বলেন, “আজ পর্যন্ত এ রকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। কী ব্যবস্থা নেব?”
জলঙ্গির অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক তাজউদ্দিন বিশ্বাস বলেন, “কে বা কারা এই সব মিথ্যে কথা রটাচ্ছে, আর অভিভাবকেরাও উদ্বিগ্ন হয়ে স্কুলে এসে পড়ুয়াদের নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতির হার অনেক কমে গিয়েছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এই গুজবের জেরে ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে মারধরের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে জলঙ্গির ঘোষপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ফরাজিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এক মাদুলি বিক্রেতাকে মারধর করা হয়। সপ্তাহ খানেক আগে লালগোলার রাধাকৃষ্ণপুর এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাকেও নিগ্রহ করা হয়েছে। পরে পুলিশ এসে ওই মহিলাকে উদ্ধার করে। এর পরেই বৃহস্পতিবার জলঙ্গির পোল্লাডাঙা গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি রুখতে গিয়ে প্রহৃত হলেন স্কুল শিক্ষক ও পুলিশকর্মীরা।
লালগোলা এলাকার এক স্কুল শিক্ষক জানান, প্রশাসন এই গুজবের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ না করলে বড় বিপদ ঘটে যেতে পারে। ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ মানুষ যে ভাবে মার খাচ্ছেন এটা অত্যন্ত উদ্বেগের। সোমবার ভাদুরিয়াপাড়া এলাকার এক শিশু কয়েক ঘণ্টা বাড়ির বাইরে ছিল। তা থেকেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে যে, তাকে ছেলেধরা তুলে নিয়ে গিয়েছে। গোটা এলাকায় হইচই শুরু হয়। পরে দেখা যায় সে প্রতিবেশীর বাড়িতে নিশ্চিন্তে খেলছে।
লালগোলা রাধাকৃষ্ণপুর মালতিপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহম্মদ কামাল হাসান বলেন, “দিন কয়েক আগে স্কুল যাওয়ার পথে দেখি গ্রামের কিছু মানুষ দৌড়চ্ছেন। পরে শুনেছি, এক অভিভাবককে কেউ ফোনে খবর দেয় যে, তাঁর ছেলে স্কুল থেকে হারিয়ে গিয়েছে। খবর শুনে সেই অভিভাবক হন্তদন্ত হয়ে স্কুলের দিকে ছুটছিলেন। তাঁকে এ ভাবে ছুটতে দেখে অন্য পাড়ার লোকজন তাঁকেই ছেলেধরা বলে তাড়া করে। ভাবুন কী অবস্থা!”
যারা গুজব ছড়াচ্ছে, এ বার তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে প্রশাসন। ডোমকলের মহকুমাশাসক পুষ্পেন্দু মিত্র বলেন, “ছেলেধরার বিষয়টি একেবারেই মিথ্যে ও ভিত্তিহীন। কিছু লোকজন এলাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরির জন্য পরিকল্পিত ভাবে এই ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে।” তিনি জানান, পুলিশকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে। “গুজব ছড়ানোর চেষ্টার খোঁজ পেলেই দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে,” বলেন তিনি।
জলঙ্গির ওসি বিশ্ববন্ধু চট্টরাজ বলেন, ‘‘এলাকায় কারা এই গুজব ছড়াচ্ছে, সে দিকে আমরা কড়া নজর রাখছি। এর পিছনে অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy