Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

নদীতে চাষ, নদীতে বাস

নিঃশব্দে মরে যায় নদী, চুপিসারে পানা আর শ্যাওলার দলে পথ খুঁজে নেয় গ্রামীণ মানুষ। তার পর? বিশ্ব জল দিবসে, সেই মরা নদীর জল ছুঁয়ে দেখল আনন্দবাজার। এই তো ক’মাস আগের কথা। হইচই পড়ে গিয়েছিল চাপড়ার তালুকহুদা গ্রামে। জলের উপর দিয়ে নাকি সবাই হাঁটছে! সে আবার হয় নাকি? অবাক করা কাণ্ড দেখতে ভিড় জমে গিয়েছিল রাতারাতি।

• ছক্কা: স্বরূপনগরে জলঙ্গির চরে চলছে খেলা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

• ছক্কা: স্বরূপনগরে জলঙ্গির চরে চলছে খেলা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৭ ০১:৪৪
Share: Save:

এই তো ক’মাস আগের কথা। হইচই পড়ে গিয়েছিল চাপড়ার তালুকহুদা গ্রামে। জলের উপর দিয়ে নাকি সবাই হাঁটছে!

সে আবার হয় নাকি? অবাক করা কাণ্ড দেখতে ভিড় জমে গিয়েছিল রাতারাতি।

কচুরিপানা জমে গিয়ে জলঙ্গি নদীর বুকে তৈরি হয়েছিল সেতু। লোকে সদলবলে নেমে পড়ে নদীতে। কেউ কেউ আবার মোটরবাইক নিয়েই নেমে পড়েছিলেন। শেষে ভিড় সামলাতে লাঠি হাতে নামতে হয় পুলিশকে। তার পর জলে ডুবে একটা কেলেঙ্কারি না হয়, সেই আশঙ্কায়।

খবর ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের গ্রামেও। ‘পানা দেখতে যাবেন নাকি’ —তৈরি হয়ে যায় অটোর রুট। ব্যস, ঝালমুড়ি-আইসক্রিমের পসরা সাজিয়ে জলঙ্গির মরা শরীরটার দু’ধারে বসে গিয়েছিল ছোটখাটো মেলা। সকলের মুখে এক কথা, ‘‘বাপের জন্মে নদীতে এমন কচুরিপানা দেখিনি বাবা।’’

তা সে হবে নাই বা কেন?

কোথাও নদীর বুকে পাট পচানো চলছে, কোথাও আবার সবুজ ধানি জমি। নদী বলে বোঝার উপায় নেই। শুধু কি তা-ই? দিনেদুপুরে চলছে নদী-চুরি। গরম কালে হয়তো শুকিয়ে আসা নদীতে বোরো চাষ করতেন কেউ। পরে সেটাকেই নিজের জমি বলে দাবি করে বসেন। ব্যস, ওমনি রাতারাতি সিমেন্ট-বালি নিয়ে বাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন তিনি।

অভিযোগগুলো যে সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, স্বীকার করে নিচ্ছেন অনেকেই। এক সময় পদ্মা থেকে বেরিয়ে আসা জলঙ্গি প্রতি বছর দু’পাড় ভাসাতো। বর্ষা মানেই ছিল বন্যা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তখন বন্যার হাত থেকে বাঁচতে সবাই মিলে উপায় বের করে। পদ্মা
থেকে জলঙ্গিতে জল ঢোকে খরিয়া নালা (অনেকে খইরি বলেন, জলঙ্গিরই একটি অংশ) দিয়ে। ওই খড়িয়া নালা বুজিয়ে দিয়ে তার
উপর তৈরি করা হয় রাস্তা। চাষিরাও খুশি। আর বন্যা নেই। তা ছাড়া নদীর পাশের উর্বর জমিটাতে ফসলও
ভাল হয়।

এর পরেও অবশ্য জলঙ্গিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল ভৈরব। কিন্তু সেটারও এক পরিণতি হয়। ডোমকলের চারুনগরের জুড়ানপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সাধারণ মানুষের দাবি ছিল, নদী বরাবর একটা রাস্তা হোক। অতএব সেতু না বানিয়ে তৈরি হয় রাস্তা। ভৈরব আর জলঙ্গির সম্পর্কে চিরকালের জন্য দাঁড়ি পড়ে যায়। ক্রমে বদ্ধ জমা জলাশয়ে পরিণত হয়েছে জলঙ্গি।

শুধু সে-ই নয়, গুমানি, গোবরানালা, ভৈরব, শিয়ালমারি, কালকুলির অবস্থাও এক।

নদীর উপর তৈরি সেতুগুলো এখনও দাঁড়িয়ে। শুধু তার নীচে আর তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীটা নেই। জেলেদের হাকডাক নেই। ছেলেপিলেদের হুটোপাটি নেই, মাছ ধরা নেই। বরং নদীর চরেই চলছে ক্রিকেট ম্যাচ। ভেসে আসে খুদেদের হুল্লোড়— ‘ছক্কা’।

চর জেগেছে জলঙ্গির মোহনাতেও। গঙ্গা দিয়ে জলঙ্গি পেরিয়ে হুলোরঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ বেশ কিছু দিন। ফেরি চলে গঙ্গা ধরেই। জলঙ্গিতে ঢোকে না।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথায়, ‘‘যত্রতত্র মানুষের এই দখলদারি বন্ধ না হলে বন্যা কমবে না। উল্টে বাড়বেই। টের পাওয়া যাবে পরে।’’ ইতিহাসও তাই বলে। ১৯৫৬, ১৯৭৮, ২০০০... সতেরো বছর আগের সেই ভয়াবহ বন্যার কথা মানুষ ভুলে গিয়েছে কবেই।

তাই দিনেদুপুরে চলছে নদী চুরি। কখনও বা ঠান্ডা মাথায় খুন।

অন্য বিষয়গুলি:

World Water Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE