চলছে মুখেভাতের অনুষ্ঠান।নিজস্ব চিত্র
বাস স্ট্যান্ডের নোংরা একফালি রাস্তাটার উপর প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিল মেয়েটা। গায়ে-হাতে-পায়ে বহু দিনের নোংরা কালি-ঝুলি, আলুথালু বেশ।
দেখেও দেখছিল না কেউ। সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছিল রাস্তার ও-ধারটা। অনেকে আবার ‘আহা, কী অবস্থা’ বলে আক্ষেপ করছিল। কিন্তু এগিয়ে আসেনি কেউ।
অবশেষে কোনও এক সহৃদয় ব্যক্তি খবর দিয়েছিলেন কান্দি মহকুমা হাসপাতালে। এগিয়ে আসে তারাই। অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। মেয়ে হয়েছিল। দিনটা ছিল ২০১৬-র ২২ সেপ্টম্বর।
সেই থেকেই সে মেয়ের ঘরবাড়ি ওই হাসপাতালের চৌহদ্দি। বাবা কোথায় জানা নেই। জন্মের দিন দুয়েক পরেই মা তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালের সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট-এ বড় হচ্ছিল শিশুটি। ডাক্তারবাবু-নার্সদের নজরদারিতে আর হাসপাতালের আয়ামাসিদের কোলেপিঠে কেটে গিয়েছে পাঁচটা মাস। ‘শ্রাবন্তী’— নামও রেখেছেন তাঁরাই। এ বার অন্নপ্রাশনের আয়োজনও করল কান্দি হাসপাতাল।
বুধবার অবশ্য অন্নপ্রাশনের কোনও দিন ছিল না। কিন্তু তাতে কী! পাঁজি দেখে, শুভ সময় নির্ধারন করে রাধাবল্লভ মন্দিরে পুজো দেওয়া হয়েছে। তার পর সেই প্রসাদ এনে পাঁচ মাসের খুদের মুখে দেওয়া হয়েছে। ঘটা করে অনুষ্ঠানটা হল বুধবার। পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচ তরকারি, মাছ, মিষ্টি— সে এক এলাহি আয়োজন। পাত পেড়ে খেয়েছে সবাই।
ইদানীং একটা প্রশ্ন উঠছিল, এ ভাবে আর কত দিন ওই ইউনিটে রাখা যাবে শিশুটিকে। প্রশাসনিক নিয়ম মেনে চাইল্ড হেল্প লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ওই চাইল্ড কেয়ার ইউনিট থেকে নিয়ে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। তাই তার আগেই শ্রাবন্তীর অন্নপ্রাশনটা ঘটা করে সেরে ফেলল হাসপাতালের কর্মীরা।
নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটের কনফারেন্স রুমে বেলুন আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। দোকান থেকে শ্রাবন্তীর জন্য আনা হয়েছিল নতুন জামা, রজনীগন্ধার মালা, ফুলের গয়না, মাথার মুটুক, আরও কত কী।
এখন মুখেভাতের রান্নাটা কে করবে? কথা উঠতেই নার্সরা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বাইরের কাউকে ও-সব দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। রান্নার ব্যাপারটা তাঁরা নিজেরাই বুঝে নেবেন।
কারও বাড়ি থেকে এল গোবিন্দভোগ চালের ভাত, পায়েস, কেউ আবার নিয়ে এলেন বেগুনভাজা, আলুভাজা, পটলভাজা, ভেন্ডিভাজা। মাছের মাথা আর মাছের ঝোলটা বানিয়ে আনেন আর এক জন। মিষ্টি মুখের মেনুতেও লম্বা লাইন। চাটনি থেকে শুরু করে রসগোল্লা, গোলাপজাম, ছানার কেক, দু’রকমের সন্দেশ, দই। আর শেষ পাতে হাজির পান। ওই ইউনিটের নার্স শুভ্র বিশ্বাস ও অর্পিতা সরকাররা বললেন, “জন্মের পর থেকেই তো আমাদের হাতে বড় হয়েছে। এ বার চাইল্ড লাইফ লাইনে চলে যাবে। ওখানে ওর অন্নপ্রাশন হবে কি না কে জানে! তাই আমরাই ঘটা করে অনুষ্ঠানটা করলাম।” শ্রাবন্তীর মুখে ভাত দিয়েছেন ওই ইউনিটের চিকিৎসক সৌমিক দাস। সৌমিকবাবু বলেন, “অন্নপ্রাশন হয়নি ভেবে বড় হয়ে শ্রাবন্তী যাতে কষ্ট না পায়, তাই আমাদের এই উদ্যোগ নিয়েছি। ও যেখানেই থাক, যেন ভাল থাকে। এই প্রার্থনাই করি।”
এই উৎসব-অনুষ্ঠানের মূল কাণ্ডারি যিনি, সেই ডাক্তারবাবু আব্দুর রোফ অবশ্য হেসে বললেন, “এখন শ্রাবন্তীর দুধ ছেড়ে ভারী খাবার খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই ভাত যখন খাওয়ানোই হবে, তখন অন্নপ্রাশনটা কেন হবে না? ও তো আর অনাথ নয়! আমাদেরই মেয়ে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy