সুনসান রথতলা। —নিজস্ব চিত্র।
ভরসন্ধ্যায় জমজমাট রানাঘাট রথতলা বাজার। ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত ক্রেতা সামলাতে। আচমকা বাজারের মধ্যে এসে দাঁড়াল গোটা চারেক মোটরবাইক। বাইক থেকে নেমে জনা আটেক যুবক সটান ঢুকে গেল বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে। মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরে এসে সিঙ্গল স্ট্রোকে বাইকে স্টার্ট দিয়ে তারা আবার মিলিয়েও গেল। একেবারে ফিল্মি কায়দায়। ততক্ষণে অবশ্য ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছেন ওই ব্যবসায়ীরা।
কী ব্যাপার? বুধবার সন্ধ্যায় বাজারের অন্য ব্যবসায়ীরা এক এক করে তখন জেনে গিয়েছেন, মোটরবাইকে যারা এসেছিল তারা এলাকার কুখ্যাত সমাজবিরোধী। কয়েকজন বাইরেরও ছিল। তারা হুমকি দিয়ে গিয়েছে, বৃহস্পতিবার বাজার বন্ধ রাখার। যে দোকানে ওই দুষ্কৃতীরা ঢুকেছিল সেই ব্যবসায়ীরা কারণ জানতে চাইলে কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে টেবিলে রেখে উত্তর এসেছিল, ‘‘যেটা বলছি, মন দিয়ে শোন। কথা বাড়াস না।” এরপর কথা তো বাড়েইনি, বরং অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে সমাজবিরোধীদের কথা।
বৃহস্পতিবার দিনভর বন্ধ ছিল রথতলার মতো ব্যস্ত বাজার। ব্যবসায়ীরাও এ দিন সাফ জানিয়েছেন, “কী দরকার বাবা, বিপদ ডেকে আনা। তাই ওদের কথামতো দোকান বন্ধ রেখেছি। লোকসান তো হলই। কিন্তু কী আর করা যাবে!” জেলার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “রানাঘাট থানায় এই বিষয়ে একটি রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছি। সেটা হাতে পেলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ঘটনার তদন্তও শুরু হয়েছে।”
পুলিশ সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, ঘটনার পরে ব্যবসায়ীদের কেউ এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে কোনও লিখিত অভিযোগ দায়ের না করলেও খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল পুলিশ। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথাও বলেছে। ব্যবসায়ীদের কাছে ওই দুষ্কৃতীদের বিবরণ নিয়ে তাদের কয়েকজনের বাড়িতে হানা দেওয়া হলেও পুলিশ কাউকেই ধরতে পারেনি।
রানাঘাট পুরসভার পূর্ব পাড়ে রথতলা বাজার। রথতলা রেলগেট থেকে নোকারি বিডিও অফিস পর্যন্ত তিনশোরও বেশি দোকান রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় ওই বাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে ঢুকেই হুমকি দেয় ওই দুষ্কৃতীরা। তাদের অধিকাংশ মদ্যপ অবস্থায় ছিল। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, তারা মদ্যপ অবস্থায় ছিল। বাজার বন্ধ রাখার কারণ জানতে চাইলে তারা আগ্নেয়াস্ত্র বের করে ভয়ও দেখায়।
রথতলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেন, “বুধবার রাতে বিষয়টি জানতে পারি। এ ভাবে দোকানে-দোকানে ভয় দেখিয়ে যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ওদের বিরোধিতা করতে চাননি বলে সিংহভাগ দোকানই বৃহস্পতিবার বন্ধ ছিল।” ওই দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যের কথা মেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, মাঝে মধ্যে দুষ্কৃতীরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে। কিন্তু এ ভাবে ভয় দেখিয়ে বাজার বন্ধ রাখার ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। রথতলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মনোজিৎ প্রামাণিক বলেন, “ব্যবসায়ীরা ভয় পেয়ে দোকান বন্ধ রেখেছিলেন। হঠাৎ করে বাজার এ ভাবে বন্ধ রাখায় পুজোর আগে ব্যবসার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।”
এ দিন বাজার বন্ধ থাকলেও বাজারে কিছু লোকজন ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলতে চাননি। এক ব্যবসায়ী যেমন বলেন, “পুলিশ তো সব জেনেও কিছু করে না। আপনার সামনে মুখ খুললে তো ওরাই এসে ফের একটা কাণ্ড ঘটাবে। তার দায় কে নেবে?” তবে এই ঘটনার পরে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, শাসক দলের ছত্রছায়ায় না থাকলে কোন সাহসে ভর সন্ধ্যায় সশস্ত্র কয়েকজন দুষ্কৃতী বাজারে ঢুকে দোকান বন্ধ রাখার হুমকি দিয়ে যায়?
রানাঘাট পুরসভার পুরপ্রধান তথা স্থানীয় বিধায়ক পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায় বলেন, “দুষ্কৃতীরা দুষ্কৃতীই। তাদের সঙ্গে আমাদের দলের যোগ থাকতে যাবে কেন? আমি বাইরে রয়েছি। ফিরে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলব।” তবে এই ঘটনায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাকেই দায়ী করে পার্থবাবু বলেন, “পুলিশের উচিত ছিল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দোকান খুলে দেওয়া। সেটা না করায় পরোক্ষ ভাবে ওই দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দেওয়া হল। দুষ্কৃতীদের এই বাড়বাড়ন্ত কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। পুলিশকে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে।”
সিপিএমের রানাঘাট জোনাল কমিটির সম্পাদক ও রানাঘাট পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর সনৎ সেনগুপ্ত বলেন, “রানাঘাট শহরে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর আমরা দলের পক্ষ থেকে রানাঘাট থানায় স্মারকলিপি দেব।” স্থানীয় কংগ্রেস নেতা নৌসাদ আলী বলেন, “এই ধরনের ঘটনা ভাবতেও খারাপ লাগে। সমাজবিরোধীরা এসে ভয় দেখিয়ে গেল। আর বাজার বন্ধ থাকল। পুলিশ-প্রশাসন বলে কি দেশে কিছুই নেই?” রানাঘাট শহর বিজেপি-র সভাপতি মনোতোষ বিশ্বাস বলেন, “তৃণমূলের আমলে দুষ্কৃতীরা তো এমনটাই করবে। আর পুলিশের কাছে থেকে এর থেকে ভাল আর কী-ই বা আশা করতে পারি!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy