আবার তারা আসিছে ফিরিয়া। বাহন থেকে পাত, বাজিমাত করতে আজও সেই সব পুরনো জিনিসের জুড়ি মেলা ভার। বিয়ের রকমারি গল্প শুনল আনন্দবাজার।
হল্লার দুষ্ট মন্ত্রীকে শাস্তি দিয়ে শুণ্ডীর প্রজাদের মুখে কথা ফিরিয়ে দিল গুপী-বাঘা। শুণ্ডীর রাজা চেয়েছিলেন, তাঁর একমাত্র মেয়ে মণিমালার সঙ্গে গুপীর বিয়ে দিতে। কিন্তু বাঘা? সমস্যা মেটাতে এগিয়ে এলেন হাল্লারাজ। তাঁর কন্যা মুক্তামালাকে তিনি তুলে দিলেন বাঘার হাতে।
বিয়ের উপহার হিসাবে রাজকন্যা কিংবা রাজত্বের ‘প্যাকেজ’ যুগ যুগ ধরেই লা জবাব। রাজা থেকে প্রজা, সম্রাট থেকে আমআদমি সকলের বিয়েতেই বিয়ের উপহার একটা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। কখনও তা জটিল রাষ্ট্রনীতির অংশ, কখনও আবার নিতান্তই লৌকিকতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপহারের লিস্টি বদলে গিয়েছে। উপহারের তালিকায় ফ্ল্যাট থেকে বিদেশে মধুচন্দ্রিমার জন্য এয়ার টিকিট বা হোটেল ভাড়া সবই ঢুকে পড়েছে। কখনও কখনও আবার উপহার স্রেফ উপহার থাকছে না। হয়ে যাচ্ছে পণের কাঁটা। সে কাঁটায় যে কত মহিলা বিদ্ধ হচ্ছেন, রক্তাক্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন— সে খবর আর কে রাখে!
শ্বশুরবাড়ির গ্রামে বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাচ্ছে জামাই। উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়েছেন পেল্লাই পিতলের ঘড়া। ভাল করে কাগজ দিয়ে মোড়ানো ঘড়ার গলায় বাঁধা দড়ি। হাতে ঝুলিয়ে নেওয়ার বেড়ে ব্যবস্থা। ঘড়া হাতে কর্তা পা বাড়াতে যাবেন ঠিক সেই সময় স্ত্রী ঘড়াটা নিয়ে কাগজের মোড়ক দিলেন খানিকটা ছিঁড়ে। কর্তা তো রেগে আগুন, ‘আরে, করছটা কী? এ তো উপহারের ঘড়া।’ স্ত্রী হাসছেন, ‘সেই জন্যই তো ছিঁড়ে দিলাম। যাতে আমার বাপের বাড়ির লোক বুঝতে পারে আমার বর ঘড়া দিচ্ছে!’ কয়েক দশক আগেও গাঁ-গঞ্জের বিয়েতে কাঁসা-পিতলের উপহারের মহিমাই ছিল আলাদা। কাঁসার জিনিসপত্র ছিল মহার্ঘ উপহার। শ্যালকের বিয়ে। কিন্তু দুই জামাইয়ের একজনও পৌঁছননি। শ্বশুরমশাই বার বার মেয়েদের কাছে জানতে চাইছেন, ব্যাপারটা কী? মেয়েরাও কিছু খোলসা করছে না। শেষে কারণ উদ্ধার করলেন শাশুড়ি। শ্যালকের বিয়েতে দুই জামাই উপহারে একে অপরকে টেক্কা দিতে চায়। যে আগে আসবে তার উপহারের কথা স্ত্রীর কাছ থেকে জেনে পরের জন উপহার কিনবে। তাই কেউ আগে আসতে রাজি নয়! নবদ্বীপ বকুলতলা হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম জানাচ্ছেন, সে কালে বহু মানুষ উপহার দিতেন নগদে। বিয়ে বাড়িতে ধামা নিয়ে বসে থাকত বর বা কনের কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। নিমন্ত্রিতরা ভোজ খেয়ে যাওয়ার আগে নগদ টাকা সেই ধামায় রাখতেন। ধামা নিয়ে বসে থাকা মানুষটি একটি খাতায় দাতার নাম আর পাশে টাকার অঙ্ক লিখে রাখত। অনেক সময় ছড়া কেটে বলা হতো—‘ফেলো আনা, খাও খানা’।
এখন অবশ্য প্রেসার কুকার থেকে রঙিন টিভি, ফ্রিজ বা অন্যান্য আধুনিক জীবনের নানা উপকরণ, শহর তো বটেই, গ্রামীণ বিয়ের উপহারের তালিকাতেও ঢুকে পড়েছে। বিয়েতে বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ বহু কালের। আবার বিয়ের আসরে প্রিয় মানুষের উপস্থিতিও তো বড় উপহার হতে পারে। সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তাঁর বড় মেয়ের বিয়েতে এমনটাই করেছিলেন। কন্যার প্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বিয়ের আসরে প্রিয় লেখককেই হাজির করাতে পারলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। সব শুনে সুনীলও রাজি। সস্ত্রীক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বিয়ের আসরে দেখে কন্যের সে কী আনন্দ! সুনীলও চটজলদি চার লাইনের একটা পদ্য লিখে উপহার দেন নোভা আহমেদকে। শোনা যায়, মুর্শিদাবাদের নবাবি বিয়েতে ‘শায়েরি’ লিখে উপহার হিসাবে দিতেন পরিবারের লোকজন। নবাবি ফরমান যে ভাবে পাঠানো হতো, সে ভাবে দু’টি সোনার দণ্ডের মধ্যে সিল্ক বা রেশমি কাপড়ে সোনার জল দিয়ে লেখা হত সেই শায়েরি। সোনার গয়নার বাক্সের মধ্যে কোরান উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কখনও প্রিয় কোনও ব্যক্তি নিজে হাতে কোরানের আয়াত লিখে রত্নখচিত বাক্সে ভরে উপহার দিতেন। সোনার বাক্সের মধ্যে হাতে লেখা এমনই এক কোরান টিপু সুলতানের বিয়েতে উপহার হিসেবে দেন কোনও নিমন্ত্রিত। তা রাখা আছে কলকাতার লাহাবাড়ির পারিবারিক সংগ্রহশালায়।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy