সেই কখন থেকে সিগনাল নেই। উসখুস করছিলেন যাত্রীরা। দু’-এক জন আপনমনে বিড়বিড়ও করলেন, ‘‘ধুত্তোর, কখন যে...।’’ কেউ কেউ আবার ভারতীয় রেলকেই খানিক গালমন্দ করলেন।
খুব অস্বাভাবিক নয়। রাতের ট্রেন। কমবেশি সকলেই সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরছেন। কেউ ট্রেনেই ঘুমিয়ে কাদা, তো কেউ বাড়ির বিছানাটার জন্য ছটফট করছেন।
হর্ন বাজল হঠাৎই। সিগনাল হলুদ। নড়ে বসলেন যাত্রীরা। অবশেষে...। আর তার পর এক পা এগিয়ে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা।
লাইনে কেউ। ‘কে আবার, একটা পাগল’— বলে উঠলেন জনৈক যাত্রী।
তার মাথায় ঝাঁকরা চুল, সারা গায়ে যেন ভুসো কালি মাখা, ছেঁড়া নোংরা জামাকাপড়। হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। হনহনিয়ে হেঁটে চলেছে লাইন ধরে। কখনও রেল লাইনের ধার দিয়ে, আবার কখনও রেললাইনের উপর দিয়ে।
মঙ্গলবার ঘড়িতে তখন রাত দশটা ছুঁইছুঁই। স্টেশনে যাত্রীদের সংখ্যা কমে গিয়েছে। সিগনাল লাল থাকায় শান্তিপুর-শিয়ালদহগামী ডাউন শান্তিপুর লোকাল রানাঘাট ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। সিগনাল হলুদ হতেই ট্রেন ছাড়ে। তখনই শুরু বিপত্তির। ট্রেনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় ওই পাগল। ফুট তিনেক আসার পরই ট্রেন দাঁড়িয়ে যায়। তাকে দেখে হর্ন বাজাতে শুরু করেন চালক। শব্দ শুনে রেল লাইনের ধার থেকে সে একটু সরে যায়। কিন্তু ট্রেন ছাড়তেই আবার লাইনের উপরে। বেগতিক বুঝে আবার ট্রেন দাঁড় করিয়ে দেন চালক।
এর পর বারবার একই কাণ্ড। দু’চার-পা হাঁটার দাঁড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু তাতে কী? লাইন থেকে তাকে সরাবে, সাধ্য কার। চালক হর্ন বাজাতেই থাকেন। কে শোনে সে সব! বাকিদের কান ঝালাপালা, পাগল নিজের তালে। এ ভাবেই গড়িয়ে গেল বেশ কয়েক মিনিট।
প্ল্যাটফর্মের নৈশআড্ডা তখনও ভাঙেনি। (সন্ধ্যার পর থেকে রানাঘাট ৫ ও ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে সময় কাটান স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই। তাঁদের কেউ আইনজিবী, কেউ শিক্ষক তো কেই সাধারণ ব্যবসায়ী) লোকজন উঠব উঠব করছিল অবশ্য। হর্নের আওয়াজে ভেস্তে গেল গল্পের আসর। উৎসুক লোকজন এগিয়ে গেল। যাত্রীরাও টুপটাপ নেমে পড়লেন ট্রেন থেকে। উদ্দেশ্য একটাই, হচ্ছেটা কী খতিয়ে দেখা। রেলের লোকজনও তত ক্ষণে ছুটে এসেছেন পাগল তাড়াতে।
৫ নম্বর প্লাটফর্মে বসে গল্প করছিলেন রানাঘাট বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মিলন সরকার। মিলনবাবু বলেন, “প্রথমে ট্রেনের হর্ন শুনে বুঝতে পারিনি, কী হয়েছে। পরে ঘনঘন হর্ন বাজতেই মনে হয়, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। ঘুরতেই দেখি ট্রেনের সামনে একটা পাগল।’’ ভাঙরাপাড়ার বাসিন্দা শিক্ষক সুশান্ত বাউলি বলেন, “ভাগ্যিস ঠিক সময়ে ট্রেন থামিয়ে দিয়েছিল ড্রাইভার।”
শেষমেশ অবশ্য তাকে নিরস্ত করা যায়। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শেষে একরকম তাড়া করেই লাইন থেকে সরানো হয় লোকটিকে। সব দেখেশুনে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বনগাঁগামী লোকালে বসে থাকা অরুণ সরকার ট্রেন থেকে নেমে পড়েন। শেষে বললেন, “বাব্বা, বাপের জন্ম এমন কাণ্ড শুনিনি। এত দিন যাতায়াত করছি, দেখিওনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy