Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Makar Sankranti

পিঠে-পুলির জন্য প্রাণ পায় ঢেঁকি

পৌষের কড়া শীতেও গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিলেন বুঁচি বিশ্বাস এবং তাঁর জনা তিনেক সঙ্গিনী। 

ঢেঁকিতে ধানভাঙা চলছে ভাতজাংলায়। নিজস্ব চিত্র

ঢেঁকিতে ধানভাঙা চলছে ভাতজাংলায়। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২০ ০২:০৭
Share: Save:

পৌষের কড়া শীতেও গলদঘর্ম হয়ে উঠেছিলেন বুঁচি বিশ্বাস এবং তাঁর জনা তিনেক সঙ্গিনী।

আদিত্যপুর গ্রামের বিশ্বাস বাড়ির গোবর-নিকানো উঠোনে ঢেঁকিতে চাল কুটছিলেন ওঁরা। রাত পোহালেই মকর সংক্রান্তি। হাতে সময় কম। তাই ঢেঁকিতে ধপাধপ পাড় দিচ্ছিলেন। কিন্তু অনভ্যাসে বিদ্যানাশ! ঢেঁকির মতো শ্রমসাধ্য কাজ কালেকস্মিনে করলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। হাঁপিয়ে নাজেহাল সবাই।

যদিও একটা সময়ে সত্তরোর্ধ্ব বুঁচি দেবী নিয়মিত ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল কুটতেন, ডাল ভাঙতেন। শুধু পালাপার্বণে নয়, বাড়ির পুরুষদের ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত ছাড়া মুখেই রুচত না। সকাল একটু বেলার দিকে গড়ালেই গৃহস্থ বাড়ির উঠোন থেকে ভেসে আসত শব্দটা। হাত দেড়েক গভীর ‘নোটের’ মধ্যে নির্দিষ্ট বিরতিতে সজোরে আছড়ে পড়া মুগুরের মতো ভারী ‘ছিয়ার’ ধপধপ শব্দ। অনেক সময়ে তার সঙ্গে মিশে থাকত মরচে পরা ‘তসিলের’ কব্জার ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। যা শুনে ঢেঁকিতে পাড় দিতে দিতে মহিলারা ছড়া কাটতেন— “ঢেঁকি স্বর্গে যাওয়ার তরে, ক্যাঁচোরম্যাচোর কান্না করে। চাল কুটতে হল বেলা, পিঠে গড়বে কোন শাশুড়ির পোলা।”

সে সব দিন এখন গল্পকথা। প্রতি দিনের জীবন থেকে ঢেঁকির ছুটি হয়ে গিয়েছে কবেই। বিশেষ করে চালকল আসার পর থেকে একেবারেই অপাংক্তেয় হয়ে পড়েছে ঢেঁকি।

এখন প্রধানত মকর সংক্রান্তির মতো বিশেষ বিশেষ সময়ে পিঠেপুলি গড়ার জন্যই একবার করে প্রাণ পায় ঢেঁকি। বুঁচিদেবীর মতো অনেকেই আছেন যাঁরা ঢেঁকি ছাঁটা চাল ঢেঁকিতে গুঁড়ো করে গড়েন রকমারি পিঠে, পুলি, পাটিসাপটা, সরা পিঠে, সেদ্ধ পিঠে, ভাজা পিঠে বা গোকুল পিঠের জিভে জল আনা সম্ভার। সংক্রান্তির দিন পুজো হয় ঢেঁকির। সেটাও পৌষপার্বণের একটা অঙ্গ।

দিনগুলো এখনও ছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পান বুঁচি। তখন তাঁরও বয়স অল্প। তিনি বলেন, “মাঠের নতুন ধান উঠলেই প্রস্তুতি শুরু হত। ঢেঁকিতে নতুন চাল গুঁড়ো করা শুরু হল মানেই মকর-পরব এসে গেল। তখন গ্রামে তিন দিন ধরে উৎসব হত। উৎসব পিঠে-পুলি তৈরি করে পাড়াপড়শিদের মধ্যে বিলানো।”

তিনি জানান, এখনও ইচ্ছা করে। কিন্তু শরীর আর দেয় না।

আবার কানাইলাল বিশ্বাসের বাড়িতে বছর দশেক হল ঢেঁকির পাট উঠে গিয়েছে। তিনি বলেন, “আটের দশক পর্যন্ত আমাদের মতো গ্রামাঞ্চলে রীতিমতো ঢেঁকির চল ছিল। তখন চাল কোটাই ছিল ঢেঁকির প্রধান ব্যবহার। তার সঙ্গে ডাল, চিঁড়ে কোটা। চালের গুঁড়ো সবই হত। তার পর লোকে চালের জন্য মিলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এখন তো আমাদের গ্রামেও বাড়ি বাড়ি মিক্সচার গ্রাইন্ডার পৌঁছে গিয়েছে।”

তবে ফের নতুন করে ঢেঁকি নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। গ্রামীণ কুটির শিল্পের নিদর্শন ঢেঁকি শিল্পমেলায় অবশ্য দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। মেলার মাঠে চোখের সামনে ঢেঁকিতে চালগুঁড়ো করে, তা দিয়ে হাতে গরম পুলিপিঠে বানিয়ে বিক্রি করছেন গ্রামীণ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। সেই পিঠের জনপ্রিয়তা দেখে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের জন্য ঢেঁকি ছাঁটা চালের কেনাবেচাও বাড়ছে দিন দিন।

এ-পার বাংলার বন্ধুর ফেসবুকে মকর সংক্রান্তির উৎসবের প্রস্তুতিতে ঢেঁকির ছবি দেখে সুদূর খুলনার সোনাডাঙা থেকে লায়লা ফতেমা সুমি লিখলেন তাঁদের অঞ্চলের ঢেঁকি নিয়ে জনপ্রিয় ছড়া— “ঢ্যাং কুরাকুর মা কাকিমা ঢেঁকিতে সুর তুলে, চাল কুটিছে ঢেঁকি ঘরে কোমর হেলেদুলে।”

অন্য বিষয়গুলি:

Makar Sankranti Grinder Pithe Puli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy