Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

মায়ের দেহ দাহ করে ফেরার পথে মৃত্যু ছেলে, চার আত্মীয়ের

দরজার সামনে বজ্রাহতের মতো বসেছিলেন প্রবীণ মানুষটি। রবিবারের অভিশপ্ত ভোর এক ধাক্কায় ওলটপালট করে দিয়েছে প্রহ্লাদ বিশ্বাসের সাজানো সংসার। তাঁরই এক ছেলে চালকের আসনে ছিলেন।

ভেঙে পড়েছেন মৃতের পরিজনেরা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ভেঙে পড়েছেন মৃতের পরিজনেরা। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৯
Share: Save:

শনিবার সন্ধ্যায় যখন মায়ের মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে পৌঁছেছিলেন, তখনও ছেলে জানতেন না পথে অপেক্ষা করছে নিয়তি। দেহ সৎকারের পর ভোরে বাড়ি ফেরার পথে মারা গেলেন ছেলে নীলমণি সরকার। প্রাণ গেল আরও চার আত্মীয় শ্মশানযাত্রীর।

দরজার সামনে বজ্রাহতের মতো বসেছিলেন প্রবীণ মানুষটি। রবিবারের অভিশপ্ত ভোর এক ধাক্কায় ওলটপালট করে দিয়েছে প্রহ্লাদ বিশ্বাসের সাজানো সংসার। তাঁরই এক ছেলে চালকের আসনে ছিলেন। লেগে আসা চোখ ঠাহর করতে পারেনি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বালির লরি। সংঘর্ষে মৃত্যু হয় প্রহ্লাদবাবুর বড় ছেলে পবিত্র, মেয়ে অনিতা এবং তেরো বছরের নাতনি সঙ্গীতার। কলকাতার হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন স্ত্রী কল্পনা। শক্তিনগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছোট ছেলে প্রমোদ বিশ্বাস।

নিজের মনেই বলে চলেছেন বিধ্বস্ত প্রবীণ—‘‘আমি তো কারও ক্ষতি করিনি। আমার কেন এমন শাস্তি হল!” কাঁদার ক্ষমতাটুকু হারিয়ে ফেলেছেন মধ্য ষাটের মানুষটি।

উঠোনের অন্য পাশে বড় ছেলে পবিত্র বিশ্বাসের ঘর। জ্ঞান ফিরলেই তীব্র আর্তনাদ করেছেন তাঁর স্ত্রী ময়না। তাঁকে সামলাতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না কানাইনগর দক্ষিণপাড়ায় প্রতিবেশীরা। বাড়ি সামনে রাস্তা, আমগাছের ছায়ায় ভিড় করেছেন শোকস্তব্ধ গ্রামের মানুষ। ভালুকা বটতলা থেকে বাঁ হাতে যে রাস্তাটি ভালুকা বাজারের দিকে গিয়েছে, সেটা ধরে কিছুটা গেলেই মধ্যমপাড়ার মুখে আর একটা জটলা। এখানেই বাড়ি মৃত শ্রীমতী সরকার এবং তাঁর ছেলে নীলমণি সরকারের। নীলমণিকে সকলে বাউল বলেই চিনতেন।

ঢালাই রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই পর পর টিনের ঘর। নীলমণি এবং তাঁর দুই ছেলে নির্মল ও মিঠুর বাসস্থান। ঠাকুমার সৎকারে একই সঙ্গে গিয়েছিলেন দুই ভাই। সঙ্গে নির্মলের স্ত্রী রিঙ্কু এবং মেয়ে বৃষ্টি। মারাত্মক জখম মা-মেয়ে দু’জনেই। থমথম করেছে গোটা পাড়া। নির্মলবাবুও পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। তাঁর আঘাত তুলনায় কম। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে শক্তিনগর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরলেন প্রতিবেশী জয়দেব মণ্ডল। পাড়ার ছেলেদের তৈরি হতে বললেন কলকাতা যাওয়ার জন্য। সেই ফাঁকে বললেন, “গোটা পরিবারের সকলেই হাসপাতালে। আহতদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। আমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে।”

মৃত পবিত্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়দেব মণ্ডল জানান, কয়েক মাস আগেই কয়েক লক্ষ টাকা ধার করে একটা লরি কিনেছিলেন পবিত্র। সবাই মিলে সাহায্য করেছিলেন। ‘‘ও যে এ ভাবে চলে যাবে আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।” বলতে বলতে নিজের পকেট থেকে বন্ধুর গলার রুপোর হার, হাতের ব্রেসলেট, মাদুলি বের করেন। হাতের মুঠোয় চাপ দিয়ে আপন মনেই বলেন, ‘‘যা, তোর সব ঋণ মাফ হয়ে গেল।”

অন্য বিষয়গুলি:

Death Accident Car Mourn
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE