প্রতীকী ছবি।
ভূখণ্ড থেকে দু’মুঠো বীজতলা নিয়ে ঝুপ করে মরা পদ্মায় ডুব দেয় ট্রাক্টর।
মরা, তবে চোরা একটা স্রোত এখনও বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখেছে নদী। ইনিয়ে বিনিয়ে বোয়াল মাছের মতো জলস্তর মেপে নিতে হয় এখনও। তার পরে খাড়াই পার ধরে পিঠভাঙা মোষের মতো ও পাড়ে উঠতেই হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে বিএসএফ—
‘আরে ভাই ইধার আও, জরুরত সে জাদা জলদি মত দিখাও!’
কথাটার মধ্যে খুনসুটির ইশারা থাকলেও নদীর লুকনো স্রোতের মতোই চোরা একটা হুমকিও কিলবিল করে। নীল ট্রাক্টরের পিছনে রংচটা হলুদ ট্রেলারটাকে টেনে হিঁচড়ে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায় লিয়াকৎ।
খসটে হয়ে যাওয়া বারমুডার পকেট থেকে বাসি চেহারার ভোটার কার্ডটা বের করতেই পরাশপুর বিওপি’র জওয়ান মুখ বেঁকিয়ে ধমক দেয়, ‘শালে, ঠিক হ্যায় যাও... ভাগো ভাগো...’
সাঁঝ নামছে। পরাশপুর, ফরাজিপাড়া, টলটলি— ধুলো-শরবন-দিগন্তের নেঁড়া গাছে ঝাঁক বাঁধা কাক, চরের প্রান্ত ছুঁয়ে জেগে থাকে ফুরনো বিকেলে। ঘোঁৎঘোঁৎ ঘড় ঘড় শব্দ তুলে লিয়াকৎ তার গ্রামের দিকে গড়িয়ে দেয় চাকা। বীজতলার উপরে আলগোছে সুয্যি ডোবে।
কাছাকাছি এসেও থমকে আছে বর্ষা। রাতের দিকে অ-বৃষ্টির আকাশে দু-একটা খয়াটে তারা। পদ্মার কোলে ও পাড়ের আতাপাড়া টিমটিম করে জেগে থাকে তখনও। তার পরে আবার আঁধার। কুষ্টিয়া আর পরাশপুরের সীমান্তে কাঁটাতারহীন অন্ধকারের কোনও আলাদা রং হয় না। দেশভাগহীন নিপাট এক সখ্য।
টলটলির বাঁকে শিশু গাছটার কাছাকাছি এসে লিয়াকতের মালুম হয়, আষাঢ়ের আঁধার আরও কিছু নিবিড় হল। প্রথম সন্ধের অন্ধকারে এক ঝাঁক কোঁচ বক হইহই করে ঘরে ফেরে। না-চেনা কিছু পাখি তাদের চরের গ্রাম ছেড়ে লাদেনের চরের দিকে উড়ে যায়। দু’পাড়ের মাঝে নদী, দুই দেশ সাঁঝের আঁধারে নিমজ্জিত একই তার রং, কালো।
লিয়াকৎ মনে মনে ভাবে, ‘ডাঁটো নদীর কি খেমতা বাবা, দুইডা দ্যাশ’রে কেমন ভেন্ন কইর্যা দিল!’ অনুশাসনহীন ছেলেবেলায়, আব্বার হাত ধরে যখন নদী পার হত, তখনও কি এমনটা ছিল! সীমানা ভাঙা পাখিদের অনায়াস উড়ে যাওয়ার মতো সেই সব দিন, কে জানে।
পদ্মা ঘেঁষা টলটলির চরে আড়েবহরে তার বাড়-বৃদ্ধির পরেও গ্রাম, পাখি, মাছেদের সঙ্গে তেমন আলাপ হল কই, নামই জানে না সকলের। লিয়াকৎ শিশু গাছটার তলায় আঁধার ফুঁড়ে ফস করে একটা বিড়ি ধরায়, ভাবে, কী হবে এই সব নাম জেনে? গাঙ থেকে মাঠ, কোথা থেকে কোথায় উড়ে-ভেসে চলে যায় তারা। এ সব অনাবিল ভাসমান প্রাণের জঙ্গমতা তার কি বোঝার কথা! সে শুধু চর থেকে চরে ভেসে বেড়ানোর দিনযাপনের কথা জানে।
নতুন চরে আবাদি জমিতে দু’মুঠো বীজতলা লাগাতে পারলে বছরে দু’টো লকলকে ধান। সময়ের কুমড়ো, শশা, সর্ষে তার পর, নদী জাগলে ফের রাত জাগানিয়া গান। ভোর রাতে ডুবন্ত চর থেকে তড়িঘড়ি অন্য ডাঙার খোঁজ করা। এই তাদের পলায়নের চেনা যাপন। নদী ভাঙছে। গ্রামের পাড় ধরে রাতজাগা গান নিয়ে জেগে থাকার আড়ালে নতুন করে সেই পলায়নের ছায়া পড়ছে যেন।
ডুমুর গাছতলায় তার ভাড়া করা ট্রাক্টরটা সাইড করে বীজতলাগুলো ঝুপঝাপ নামিয়ে রাখে লিয়াকৎ। চাষটা তো শুরু হোক। তার পর এলার মাঠ, নাজিবুলদের বাড়ি, ফ্লাড শেল্টারের বাঁক ঘুরে উঁচুডাঙার কবরের কাছে নদী এসে দাঁড়ালে ফের ভেসে পড়তে হবে।
কুষ্টিয়ার আকাশ ফুঁড়ে মাগরিবের আজান পদ্মার স্রোত উজিয়ে ভেসে আসে। লিয়াকৎ ভাবে আব্বা থাকলে এতক্ষণে ঠিক নতমুখে সঁপে দিত নিজেকে। আকাশ, আজানের সুর আর আব্বার কবর— কেমন অন্যরকম লাগে তার সন্ধেটা।
হাত-মুখে জল ছিটিয়ে মরা শশার মতো ঠান্ডা চুনো মাছের ঝোল দিয়ে গোগ্রাসে এক থালা জল-ভাত খায় সে। আজ খানিক আগেই বেরিয়ে পড়বে। আঁধার ফুঁড়ে আজ খুব মন দিয়ে নতুন ডাঙার খোঁজ করবে। লণ্ঠনটা উস্কে দিয়ে কড়ুই গাছের শক্তপোক্ত লাঠিটা ঘরের কোণ থেকে বের করে আনে, ‘বাইর অইলাম...।’
বালক বেলায় আব্বা আর মন যখন ফিঙের মতো উচাটন তখন এক রাতের জ্বরে ভাই— চর জেগে থাকলে শুকনো পাতার আড়াল সরিয়ে কবর দু’টো ঠিক খুঁজে বের করত লিয়াকৎ। ভাঙনের উচ্ছ্বাসে ফেলে আসা সেই চর এখন পদ্মার জঠরে ঘুমিয়ে আছে। নদীর তলপেটে এখনও কি সাড়ে তিন হাত জমিনেই শুয়ে আছে বাপ-ভাইজান— বেঘোর দুপুরে মাঝে মাঝে মনে পড়ে লিয়াকতের।
টলটলির চরে নতুন করে বাসা বাঁধার পরে, দরমার ঠেস দেওয়া এক ফালি ঘরে মা আর নিজের ছাড়া আর কোনও ছায়া দেখেনি সে। তবু তো ছায়ার মতোই আঁকড়ে ছিল মা। বছর তিনেক আগে সইদা বেওয়ার কবরে মাটি দেওয়ার পরেও, ঘরের বাইরে পা রাখলে কারে যেন জানিয়ে যায় সে, ‘বাইর অইলাম’! আজ ঘাসপাতা সরিয়ে মায়ের কবরটা এক বার দেখে আসবে, বিড়ি ধরিয়ে উঁচুডাঙার দিকে হাঁটতে থাকে লিয়াকৎ।
আজ, অজস্র বাদুড়ের ওড়াউড়ি। নামহীন এক রাতচরা পাখি থেকে থেকেই ককিয়ে ওঠে....টিররর টিট টিট টিট। লণ্ঠনটা উস্কে পাগলের মতো মরা পাতার স্তূপ থেকে মায়ের গোরটা খুঁজতে থাকে লিয়াকৎ। তার উন্মাদ-অন্বেষণের মাঝেই টের পায় বৃষ্টি শুরু হল। টিপটিপ থেকে ঝিরঝির হয়ে কান্নার মতো ঝরছে এখন আষাঢ়। জল ফোঁটার আঘাতে ঝুপ করে নিভে যায় লণ্ঠন। হাতা ছেঁড়া গেঞ্জিটা ভিজে জবজব করছে। দু’পায়ে চরের গভীর কাদা, তার মুখ, চুল, চোখের পাতা ভিজে থইথই করছে, ‘গোরখান গেল কই...!’ পাগলের মতো মায়ের কবর খুঁজতে থাকে লিয়াকৎ। কোত্থাও নেই...কোথাও...
নদীর কোল থেকে ভেসে আসে চর জাগানিয়া গানের ক্লান্ত সুর উড়ে আসে ‘—ঘর গ্যাসে দোর গ্যাসে/ সব গ্যাসে গো/ আল্লাহর দুয়ায় চর আসে (আছে)/ মোনাজাত কর গো’
...লিয়াকতের গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কি এক অবোধ কষ্ট। একলা থেকে আরও একলা হয়ে যাওয়ার কী তীব্র এক যন্ত্রণা। বৃষ্টি নিথর কবরে অনেক দিন পরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে লিয়াকৎ, ‘মা কই গেলি গো...’ বৃষ্টি ভেজা চরের রাত এমন অনুযোগহীন কান্না কোনও দিন শোনেনি।
এতক্ষণে ঠিক নতমুখে সঁপে দিত নিজেকে। আকাশ, আজানের সুর আর আব্বার কবর— কেমন অন্যরকম লাগে তার সন্ধেটা।
হাত-মুখে জল ছিটিয়ে মরা শশার মতো ঠান্ডা চুনো মাছের ঝোল দিয়ে গোগ্রাসে এক থালা জল-ভাত খায় সে। আজ খানিক আগেই বেরিয়ে পড়বে। আঁধার ফুঁড়ে আজ মন দিয়ে নতুন ডাঙার খোঁজ করবে। লণ্ঠনটা উস্কে কড়ুই গাছের শক্তপোক্ত লাঠিটা ঘরের কোণ থেকে বের করে আনে, ‘বাইর অইলাম...।’
বালকবেলায় আব্বা আর মন যখন ফিঙের মতো উচাটন তখন এক রাতের জ্বরে ভাই— চর জেগে থাকলে শুকনো পাতার আড়াল সরিয়ে কবর দু’টো ঠিক খুঁজে বের করত লিয়াকৎ। ভাঙনের উচ্ছ্বাসে ফেলে আসা সেই চর এখন পদ্মার জঠরে ঘুমিয়ে আছে। নদীর তলপেটে এখনও কি সাড়ে তিন হাত জমিনেই শুয়ে আছে বাপ-ভাইজান— বেঘোর দুপুরে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে লিয়াকতের।
টলটলির চরে নতুন করে বাসা বাঁধার পরে, দরমার ঠেস দেওয়া এক ফালি ঘরে মা আর নিজের ছাড়া আর কোনও ছায়া দেখেনি সে। তবু তো ছায়ার মতোই আঁকড়ে ছিল মা। বছর তিনেক আগে সইদা বেওয়ার কবরে মাটি দেওয়ার পরেও, ঘরের বাইরে পা রাখলে কারে যেন জানিয়ে যায় সে, ‘বাইর অইলাম’! আজ ঘাসপাতা সরিয়ে মায়ের কবরটা এক বার দেখে আসবে লিয়াকৎ।
আজ, অজস্র বাদুড়ের ওড়াউড়ি। নামহীন এক রাতচরা পাখি থেকে থেকেই ককিয়ে ওঠে....টিররর টিট টিট টিট। লণ্ঠনটা উস্কে পাগলের মতো মরা পাতার স্তূপ থেকে মায়ের গোরটা খুঁজতে থাকে লিয়াকৎ। তার উন্মাদ-অন্বেষণের মাঝেই টের পায় বৃষ্টি শুরু হল। টিপটিপ থেকে ঝিরঝির হয়ে কান্নার মতো ঝরছে এখন আষাঢ়। জল ফোঁটার আঘাতে ঝুপ করে নিভে যায় লণ্ঠন। গেঞ্জিটা ভিজে জবজব করছে। দু’পায়ে চরের গভীর কাদা, তার মুখ, চুল, চোখের পাতা ভিজে থইথই করছে, ‘গোরখান গেল কই...!’ পাগলের মতো মায়ের কবর খুঁজতে থাকে লিয়াকৎ। কোত্থাও নেই...কোথাও...
নদীর কোল থেকে উড়ে আসে চর জাগানিয়া গানের ক্লান্ত সুর—‘ঘর গ্যাসে দোর গ্যাসে/ সব গ্যাসে গো/আল্লাহর দুয়ায় চর আসে (আছে)/মোনাজাত কর গো....
...লিয়াকতের গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কি এক অবোধ কষ্ট। একলা থেকে আরও একলা হয়ে যাওয়ার কী তীব্র এক যন্ত্রণা। বৃষ্টি নিথর কবরে অনেক দিন পরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে লিয়াকৎ
— মা কই গেলি গো...
বৃষ্টি ভেজা চর এমন অনুযোগহীন কান্না কোনও দিন শোনেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy