চাপের মুখে কোটি কোটি টাকার জমি জলের দরে বিক্রি করার ব্যাপারে কি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নির্যাতিতা সন্ন্যাসিনী? আর সে জন্যই কি তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় জমি-মাফিয়াদের চক্ষুশূল? রানাঘাট-কাণ্ডের তদন্তে নেমে এমন একটা সম্ভাবনারও উত্তর খুঁজছেন সিআইডি-র তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দাদের বক্তব্য, রানাঘাটের ডাকাতি ও ধর্ষণ দেখে প্রথম থেকেই তাঁদের মনে হয়েছে, এর পিছনে বড় ধরনের কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে। নিছক ডাকাতি করতে এসে এই ঘটনা ঘটানো হয়নি। তদন্তের সেই অভিমুখ থেকেই উঠে এসেছে এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-কারবারের কাহিনিও।
কী রকম সেই জমি-কারবার?
সিআইডি সূত্রের খবর, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে প্রায় কুড়ি বিঘা জমি রয়েছে ওই কনভেন্ট স্কুলটির। এ ছাড়াও আরও কিছু জমি রয়েছে এদিক-ওদিক এবং সেগুলির সিংহভাগই জাতীয় সড়কের কাছাকাছি। সম্প্রতি ওই জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাই জাতীয় সড়ক লাগোয়া জমি হয়ে উঠেছে সোনার খনি। সিআইডি স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানতে পেরেছে, এলাকায় রাস্তার ধারে যে জমির দাম কিছু দিন আগেও ছিল কাঠা পিছু চল্লিশ হাজার টাকা, সেটাই এখন বেড়ে হয়েছে তিন থেকে পাঁচ লাখ! স্থানীয়দের বক্তব্য,
রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ শেষ হলে এই জমির দাম আরও দশ-বিশ গুণ বেড়ে যাবে।
এই সম্ভাবনা থেকেই এই এলাকায়, বিশেষত রাস্তার ধারের জমি কব্জা করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে একদল মাফিয়া। টাকার থলে হাতে নিয়ে বেপরোয়া ভাবে রাস্তার লাগোয়া জমি কিনতে শুরু করেছে তারা। স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে গোয়েন্দারা জেনেছেন, মাফিয়াদের জমি বিক্রি না করতে চাইলে বিপদে পড়তে হচ্ছে। তাদের চোখরাঙানির মুখে অনেকেই বাজারদরের থেকে অনেক কম দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
গোয়েন্দারা জেনেছেন, সম্প্রতি রানাঘাটের ওই কনভেন্ট স্কুলটি অনেকটা জমি বিক্রি করেছে। এবং ওই জমি বিক্রি করা হয়েছে কার্যত জলের দরেই। কী সেই দাম? গোয়েন্দারা জেনেছেন, মাস ছ’য়েক আগে স্কুলের মালিকানাধীন ৮০ কাঠা জমি বিক্রি করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লক্ষ টাকায়। অথচ সে সময় ওই জমির বাজারদর ছিল পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। কেন এত কম দামে ওই জমি বিক্রি করা হল তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের বক্তব্য, স্কুলের বাকি জমিও বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। কোনও চাপে পড়ে সেই জমিও কম দামে বিক্রি করার হচ্ছিল কি না, তা জানার চেষ্টা চালাচ্ছে সিআইডি।
কিন্তু এর সঙ্গে ওই রাতের দুষ্কৃতী হানার কী যোগাযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা?
তদন্তকারীদের মতে, স্কুলের অন্যান্য সন্ন্যাসিনীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, জাতীয় সড়ক লাগোয়া ওই ৮০ কাঠা জমি বিক্রি করতে প্রথমে রাজি ছিলেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরে সেই জমি তাঁরা কার্যত জলের দরে বিক্রি করে দেন। এর পরে জমি মাফিয়াদের নজরে পড়ে জাতীয় সড়ক লাগোয়া স্কুলের মালিকানাধীন ২০ বিঘে জমির উপরে। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “স্কুলের একাধিক সিস্টার ও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, ওই জমি বিক্রিতে আপত্তি করেন মূলত ওই সন্ন্যাসিনীরই।” তাঁর যুক্তি ছিল, ওই জমিতে প্রায় হাজার খানেক গরিব খ্রিস্টান মানুষও বাস করেন। সূত্রের দাবি, সন্ন্যাসিনীর বক্তব্য ছিল, মাফিয়াদের হাতে ওই জমি তুলে দিলে ওই গরিব মানুষরা আশ্রয়হারা হবেন। এবং সে কারণেই আপত্তি তুলেছিলেন তিনি।
সিআইডি সূত্রের খবর, এই আপত্তির সঙ্গে দুষ্কৃতী হামলার কোনও সম্পর্ক আছে কি না, এখন সেটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রানাঘাট শহর ও গ্রামীণ এলাকার একাধিক জমি কারবারি এবং দালালকে ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শাসকদলের মদতেপুষ্ট একাধিক জমি-মাফিয়া স্কুলের সম্পত্তি দখল করার জন্য মাঠে নেমেছিল। এমনকী দিন পনেরো আগে টাকা চেয়ে ওই স্কুলে যে হুমকি ফোন এসেছিল, তার পিছনেও এই জমি-তত্ত্ব থাকতে পারে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, গাংনাপুর থানায় স্কুলের তরফে ওই ফোন পাওয়ার পরে একটি অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল। তদন্তকারী এক অফিসারের কথায়, “সে দিন ফোন করে ঠিক কী ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। এ নিয়ে স্পষ্ট করে মুখও খুলতে চাইছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ।” কেন? তার উত্তর এ দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে সিআইডি-র দাবি। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে স্কুলের সিস্টার ও কর্মচারীদের দফায় দফায় জেরা করা হয়েছে। সিআইডির এডিজি রাজীবকুমার নিজে গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এক তদন্তকারীর কথায়, কিছু সূত্র মিলেছে। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy