Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ভাল’ হওয়ার লড়াই ঠেলছে অন্ধকারে

কলকাতার নামী স্কুলের মেধাবী ছাত্রী কৃত্তিকা পালের আত্মহত্যা ও তিন পাতার সুইসাইড নোট নিয়ে যখন তোলপাড় পড়েছে, সেই সময়ে পড়ুয়াদের অতিরিক্ত ‘সিরিয়াসনেস’ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৯ ০১:০৯
Share: Save:

দূরদর্শনে জীবনে প্রথম বার অনুষ্ঠান করতে এসেছিল অষ্টম শ্রেণির কিশোরী। বেহালা বাজাবে। স্টুডিয়োয় অপেক্ষার সময়ে হাতে মোটাসোটা একটা খাতা দেখে অনুষ্ঠানের প্রযোজক জানতে চান। গম্ভীর মুখে কিশোরী বলে ওঠে, “ফিজিক্যাল সায়েন্সের খাতা। সময় আছে, তাই পড়াটা এগিয়ে রাখছি।”

হতবাক প্রযোজক আর কোনও কথা বলতে পারেননি।

কলকাতার নামী স্কুলের মেধাবী ছাত্রী কৃত্তিকা পালের আত্মহত্যা ও তিন পাতার সুইসাইড নোট নিয়ে যখন তোলপাড় পড়েছে, সেই সময়ে পড়ুয়াদের অতিরিক্ত ‘সিরিয়াসনেস’ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন অনেকেই। তাঁরা সরাসরি আঙুল তুলছেন বাবা-মায়েদের দিকেই। অভিভাবকদের প্রত্যাশার চাপেই এমনটা ঘটছে বলে তাঁদের একাংশের অভিমত।

চাকদহ রামলাল অ্যাকাডেমির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সোমনাথ মজুমদার মনে করেন, সেই নার্সারি ক্লাস থেকেই সন্তানদের উপরে ইচ্ছার বোঝা চাপাতে থাকেন বাবা-মায়ের। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের খারাপ দিকটা না ভেবেই।

তিনি বলেন, “নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের জন্য সন্তানকে বেছে নিচ্ছেন তাঁরা। কোন ছাত্রের স্বাধীনতা নেই কী পড়বে, তা ঠিক করার।’’

তাঁর মতে, সন্তান গবেষক বা সাহিত্যিক হতে চাইলে সেটা প্রায় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে! সোমনাথ বলেন, ‘‘সামাজিক ভাবে কৌলীন্য পেতে হলে সন্তানকে কিছু একটা হতেই হবে। এখানেই লুকিয়ে আছে সমস্যার বীজ।”

যদিও কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন বিশ্বাস বলছেন, “যারা ভালো ছেলেমেয়ে, তারা চাপ নিতে খুব অভ্যস্ত। ওরা চাপ নিতে পছন্দ করে। শুধু অভিভাবকেরাই সারা ক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ওদের উপর চাপ দিচ্ছেন, এমনটা আদৌ নয়।’’

তাঁর মতে, ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা তো থাকেই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পড়ুয়াই চাপটা বহন করে। মনোরঞ্জন বলছেন, ‘‘ভাল রেজাল্ট করতে হবে, তা না হলে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা পছন্দের কোনও বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না, এই ভাবনা পড়ুয়াদের তাড়িয়ে নিয়ে বেরায়।”

এই সময়ের অভিভাবকদের প্রসঙ্গে মনোরঞ্জনের অভিমত, “এখনকার অভিভাবকেরা অনেক সচেতন। প্রতিযোগিতার বাজারে সন্তানের কেরিয়ার তৈরির জন্য তাঁরা যদি সচেষ্ট থাকেন, তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় না। সচেতন ভাবে তাঁরা এমন কিছু করবেন না বলেই মনে হয়, যা সন্তানকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেবে!”

তা হলে কি এই চাপ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই ডেকে আনছেন?

নবদ্বীপ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শ্রুতি লাহিড়ী বলছেন, “ভাল ছাত্রীর মুখে চট করে হাসি দেখতে পাবেন না। সব সময়ে একটা টেনশন। পড়াশোনা নিয়ে নিজের উপরে কখনওই সন্তুষ্ট নয়। ভয়ে ভয়ে থাকে এই বুঝি নম্বর কমে গেল কিংবা এই বুঝি ক্লাসে তার জায়গা অন্য কেউ দখল করে নিল।’’

যদিও এই অবস্থার জন্য অভিভাবকদের দায়ী করতে নারাজ শ্রুতি। তিনি বলেন, “আমার স্কুলের একটি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল সম্প্রতি এর জন্য এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে, ওকে নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসা করাতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা অসহায় ভাবে জানিয়েছেন তাঁরা এত চাপ নিতে বারণ করেছেন। কিন্তু কথা শুনলে তো।”

করিমপুর পান্নাদেবী কলেজের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানের গবেষক প্রসেনজিৎ সাহা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “বহু ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের সাফল্য তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠার একটা মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এ জন্য শুরু হয় অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। যার পরিণতি এই অন্ধকার।”

অন্য বিষয়গুলি:

Krittika Pal Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy